সাতক্ষীরায় ৪১৫ শিক্ষকের মানবেতর জীবন, বদলে ফেলছেন পেশা
পেশা বদলে বিক্রয় প্রতিনিধি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক
করোনার কারণে সরকারি নির্দেশনায় দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পেশা বদল করছেন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকরা। জীবিকার তাগিদে কেউ প্রাইভেট কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির চাকরি নিয়েছেন, কেউবা ব্যবসা করছেন আবার কেউ দিনমজুরি করছেন।
সাতক্ষীরায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ৪১৫ জন শিক্ষক পেশা বদল করেছেন। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই শিক্ষকদের ভাগ্যে দুর্দিন নেমে এসেছে। তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোনো সরকারি সহায়তাও। তবে কিছু কিন্ডারগার্টেন সচল রয়েছে। সেখানে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, জেলার সাতটি উপজেলায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সংখ্যা ১৫৮টি। এসব স্কুলে শিক্ষক রয়েছেন ৭৯০ জন। শিক্ষার্থী ৬ হাজার ৬০০ জন। করোনার কারণে গত দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে ৮০টি কিন্ডারগার্টেন স্কুল। এতে কর্মহীন হয়ে পেশা বদল করেছেন ৪১৫ জন শিক্ষক। ৭৮টি কিন্ডারগার্টেন কিছুটা সচল রয়েছে। সেখানে অনলাইনে ক্লাস চলছে। এছাড়াও বন্ধ হয়ে যাওয়া কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা পার্শ্ববর্তী মাদরাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের হাজারাকাটি এলাকায় ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় আব্দুর রহমান আদর্শ একাডেমি। প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া চলতো স্কুলটিতে। স্কুলটিতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৯৩ জন। তবে করোনাকালে বন্ধ হয়ে গেছে স্কুলটি। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান এখন হোমিও চিকিৎসক, সহকারী শিক্ষক পারভেজ এখন চা কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। এছাড়া বাকি সাত শিক্ষকও পেশা বদলে ফেলেছেন।
বিজ্ঞাপন
আব্দুর রহমান আদর্শ একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রহমান বলেন, স্কুলটিতে ৯ জন শিক্ষক ছিলেন। ১৯৩ জন ছাত্রছাত্রীর যাতায়াতে জাকজমকপূর্ণ পরিবেশ ছিল স্কুলটিতে। তবে করোনার কারণে দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে স্কুলটি। আমি এখন হোমিও চিকিৎসার দোকান দিয়েছি। অন্যরাও পেশা বদল করে ফেলেছেন। কেউ কেউ প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালাচ্ছেন। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা আমরা পাইনি। মানবেতর জীবনযাপন করছেন শিক্ষকরা। ছাত্রছাত্রীদের বেতনের টাকায় সম্মানি পেতেন শিক্ষকরা।
ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক পারভেজ হোসেন জানান, আমি এখন ধানের বিচালির ব্যবসা করছি। এছাড়া রয়েল কিং ব্ল্যাক টি কোম্পানির তালা উপজেলা বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে কিনা অনিশ্চিত। সংসারের অবস্থা খুবই খারাপ। মা-বাবা অসুস্থ। কষ্ট হলেও সংসার তো পরিচালনা করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের কোনো প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে না। ব্যবসা করবো কোনো ঋণও পাচ্ছি না। সরকারের কাছে দাবি জানাবো আমাদের জন্য যেন কিছু করা হয়।
এদিকে করোনার মধ্যে সচল রয়েছে সাতক্ষীরা প্রি-ক্যাডেট স্কুল। সেখানে শিক্ষার্থী রয়েছে ৩০০ জন। তবে করোনার মধ্যে ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
সাতক্ষীরা প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আনিসুর রহিম জানান, শিক্ষকরা প্রতি বুধবার বিদ্যালয়ে এসে প্রশ্ন ও সিট বের করার কাজ করছেন। এরপর রোববার শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি সেগুলো পৌঁছে দিচ্ছেন। বাকি দিনগুলোতে স্কুলে কোনো কাজ না থাকায় স্কুলে আসেন না শিক্ষকরা। স্কুলের ৩০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৩৫ জন শিক্ষার্থী প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের হার ৭৮.৩৩ শতাংশ। বাকি ২১ ভাগ শিক্ষার্থীর অবস্থান জানা যায়নি। এসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব স্কুল ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলে। আমরা শুধুমাত্র বই দিয়ে থাকি। এছাড়া সেখানে আমাদের কাজ নেই। করোনার কারণে জেলার অর্ধেক কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। শহরকেন্দ্রিক কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনের মাধ্যমে চালু রয়েছে। জেলার এমন ১৫৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭৮টি চালু রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এসব স্কুলের ৭৯০ জন শিক্ষকের মাঝে পেশা বদল করেছেন ৪১৫ জন শিক্ষক।
তিনি আরও বলেন, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোনো সমস্যা হবে না। কাগজপত্র ছাড়াই তারা পার্শ্ববর্তী যে কোনো সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে পারবে। সরকার ভর্তির বিষয়গুলো সহজ করে দিয়েছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা পার্শ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদরাসায় ভর্তি হয়েছে। কিছু শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হয়েছে আবার কিছু শিক্ষার্থী পরিবারে অভাব-অনটনের কারণে অন্যত্র কাজে চলে গেছে। সরকারি সিদ্ধান্তে স্কুল খুলে দেওয়ার পর কত শিক্ষার্থী ঝরে পড়ল সেটির একটি চিত্র পাওয়া যাবে।
আকরামুল ইসলাম/আরএআর