চলমান কঠোর বিধিনিষেধের কারণে উৎপাদিত দুধ বিক্রি করতে পারছেন না পটুয়াখালী জেলার খামারিরাসহ দুধ বিক্রেতারা। দুধ কেনার উৎস মিষ্টি, ঘোষ, পনিরের দোকান বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে খুচরা বাজারে ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে দুধ বিক্রি করছেন খামারিরা। আবার এই দামেও দুধ বিক্রি করতে না পেরে খামারিরা বাড়িতে না নিয়ে তা নদীতে ফেলে দিচ্ছেন।

তবে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে ভিন্ন কথা। তারা বলছে, দুধ অবিক্রীত থাকে, এ অভিযোগ সত্য নয়। জেলায় চাহিদার চেয়ে দুধের উৎপাদন কম। সরকারিভাবে খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে।

জানা গেছে, উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীতে জেলায় ৩ হাজার ৫৩৮টি খামারে গরু লালনপালন করা হয়। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে গরু লালনপালন করা হয়। এতে জেলায় প্রচুর পরিমাণে দুধ উৎপাদিত হয়। যা জেলার চাহিদা পূরণ করে বাইরের জেলায় সরবরাহ করা হয় বলে জানান খামারিরা। তবে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের কারণে মিষ্টি, ঘোষ, পনির উৎপাদনকারীরা দুধ কিনতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে খুচরা বাজারে ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে দুধ বিক্রি করে লোকসান গুনছেন খামারিরা।

এ রকম চলতে থাকলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে দুধের খামারগুলো। তাই দুধ বাজারজাতকরণের সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান খামারিরা।

সদর উপজেলার জৈনকাঠি ঠেঙ্গাই এলাকার দুধ বিক্রেতা মো. কবির বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি প্রতিবন্ধী মানুষ। সকালে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ সংগ্রহ করি। এরপর শহরে এনে তা মিষ্টির দোকানে বিক্রি করি। তবে লকডাউনের কারণে শহরের সব মিষ্টি দোকান বন্ধ আছে। তাই অনেক দোকানে ঘুরতে ঘুরতে এখন আমি ক্লান্ত। আগে যে দুধ লিটার ৮০ টাকায় বিক্রি করতাম, আজ ২৫ টাকায়ও বিক্রি হয় না। সারাদিন মাত্র ২০০ টাকার দুধ বিক্রি করছি। এতে গরুর পরিচর্যার টাকাও ওঠাতে পারি না। সরকার আমাদের দিকে না তাকালে আমরা পথে বসে যাব।

একই কথা সদর উপজেলার লোহালিয়া কুড়িপাইকা এলাকার দুধ বিক্রেতা আবুল ফকিরের। তিনি বলেন, প্রতিদিন গ্রাম থেকে দুধ শহরে এনে মিষ্টির দোকানে বিক্রি করতাম। লকডাউনের কারণে আমরা এখন বিপদে পড়ে গেছি। এখন দুধ লিটার ২০ টাকা বিক্রি করতে হয়। তা দিয়ে সংসারও চলে না। গরুরে খাওয়ামু কী? আগে লিটার ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করতাম। এখন খরচ তোলাও কষ্টকর।

দুমকী উপজেলার শ্রীরামপুর এলাকার দুধ বিক্রেতা হান্নান বলেন, মিষ্টির দোকানদারদের রাখার অনুরোধ করি। কিন্তু দোকান বন্ধ থাকলে তা কী করবে? এ জন্য বাজারে দুধের দাম কমে গেছে। এখন যে দরে বিক্রি করি, তা দিয়ে গরুর খড়-খৈল কেনার টাকা হয় না। তিনি আরও বলেন, এখন যে অবস্থা, তাতে গরু লালনপালন কেমনে করব? আর আমরা খামু কী? তাই রাগ করে দুধ পানিতে ফেলে দিয়েছি। বাড়িতে নিয়ে রাখব কোথায়?

শহরের পুরান বাজার জি এম সুইটসের পরিচালক পলাশ বলেন, আমার দোকানে প্রতিদিন ৫০০ কেজি দুধের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বিধিনিষেধের মধ্যে দোকান বন্ধ থাকায় আমি তা কিনতে পারছি না। কোনো (মিষ্ট-ছানা) উৎপাদন নেই। উৎপাদন বন্ধ থাকলে দুধ কিনে কী করব? তিনি আরও বলেন, এই লকডাউনে আমাদের থেকেও দুধ বিক্রেতারা বেশি কষ্টে রয়েছেন? তারা প্রতিদিন দুধ নিয়ে আসেন। কিন্তু আমরা রাখতে পারি না। আমরাও নিরুপায় হযে গেছি।

শহরের পৌর এলাকার বিখ্যাত সুবর্ণা সুইটসের মালিক বলেন, আমার মিষ্টির দোকানে ১৫ জন দুধ বিক্রেতা দুধ বিক্রি করতেন। কিন্তু দোকান বন্ধ থাকায় আমি কিনতে পারছি না, তারাও বেচতে পারছেন না। দুধ বিক্রেতারা এসে বলে একটু কম দামে হলেও কিনে রাখতে। তবু আমরা তাদের ফিরিয়ে দিই। আমাদের কিছু করার নেই। এদিকে খামারিরা গরুর দুধ সংরক্ষণ না করলে গরু মারাও যেতে পারে। তারাও গরু নিয়ে এখন বিপদে রয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে দুধ বিক্রেতারা অনাহারে জীবন কাটাবেন।

পটুয়াখালী পৌরসভার মেয়র ও পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক খামারি তাদের দুধ বিক্রি করতে না পেরে পানিতে ফেলে দিচ্ছেন। এতে তারা খামার করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। যেহেতু মহামারি, সে ক্ষেত্রে মিষ্টি-ঘোষ-পনির দোকানিরা উৎপাদন করে অনলাইনে বিক্রি করতে পারলে ভালো হবে। দুগ্ধজাত পণ্য ও খামারিরা যাতে তাদের সঠিক দাম পান, তার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।

পটুয়াখালী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আনোয়ার হোসেন বলেন, জেলায় দুধের বার্ষিক চাহিদা ১ দশমিক ৬ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদিত হয় ১ দশমিক ০৯ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদার ঘাটতি রয়েছে শূন্য দশমিক ৫১ লাখ মেট্রিক টন। দুধ-জাতীয় পণ্য পরিবহনে কোনো বাধা নেই। ডেইরি খামারিদের দুধ তারা ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির করতে পারছেন। আমরাও সরকারিভাবে দুধ সরবরাহ করছি। তবে তাদের সহযোগিতা করা হবে।

আর প্রশাসনের আদেশ অনুযায়ী মিষ্টির দোকান চালু রয়েছে। তবে অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে চালু থাকায় দুধ কিনতে পারেন দোকানিরা বলে জানান এই কর্মকর্তা।

মহিব্বুল্লাহ্ চৌধুরী/এনএ