বিয়ের পরও লুকিয়ে সিনেমা দেখতে যেতাম
‘আমরা যখন সিনেমা দেখতাম, তখন হলের পরিবেশও ভালো ছিল, সিনেমাও ভালো ছিল। তখন সবাইকে নিয়েই সিনেমা দেখতাম। ঈদ এলে সব কাজকর্ম গুছিয়ে চলে যেতাম সিনেমা হলে। এতটাই সিনেমার ভক্ত ছিলাম। শাবানা, রাজ্জাকসহ আরও অনেকের সিনেমাই দেখেছি। আমি সিনেমা দেখি ছোটবেলা থেকেই। যখন আমার বয়স ১০ থেকে ১১ বছর, তখন চাচা-চাচি হলে নিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখতেন। এভাবেই সিনেমাপাগল হয়ে ওঠা।’
স্মৃতির ডানা মেলে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন সিনেমাপ্রেমী নারী ফাতেমা খাতুন। ঈদ এলেই মাইকে সিনেমার বার্তা জানা আর হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সেই স্মৃতি এখনো গেঁথে আছে তার মানসপটে।
বিজ্ঞাপন
ফাতেমা বলতে থাকেন, বিয়ে হওয়ার পরও লুকিয়ে সিনেমা দেখতে যেতাম। শ্বশুর সিনেমা দেখা পছন্দ করতেন না, তাই বাবার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে সিনেমা দেখে আসতাম। সব সময় এভাবেই ভাই-ভাগ্নেদের নিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখে আসতাম। একবার আমার মেয়ে বলে দিয়েছিল তার দাদার কাছে যে আম্মু সিনেমা দেখতে গিয়েছে। বাড়িতে ফেরার পর তিনি জানতে চাইলেন, আমি বলেছি, সিমেনা দেখতে যাইনি, বাবার বাড়ি থেকে চাচার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। পরে আর কিছু বলেননি। এভাবে মিথ্যা বলে কত যে সিনেমা দেখেছি। কারণ, তখন সিনেমার নেশা ছিল প্রচণ্ড।
বিজ্ঞাপন
ফাতেমা খাতুনের বাবার বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে। বিয়ে হয়েছিল বাড়ির কাছাকাছিই। একসময় স্বামীর চাকরি সূত্রে কিশোরগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ চলে আসতে হয়েছে তাকে। এরপর আর লুকিয়ে দেখতে হয়নি। নিয়মিতই হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন তিনি।
সেসব এখন খুব মিস করি। এখন ছেলে-মেয়ে কিংবা নাতিরা যখন নাটক-সিনেমা দেখে, তখন তাদের বলি যে আমরা যা দেখেছি, এখন তো তোমরা সেগুলোর ধারেকাছেও নাই। তখন খুব সুন্দর সুন্দর সিনেমা দেখেছি। সামাজিক ছবি দেখেছি। এখন তো এগুলোর কিছুই নাই, আক্ষেপের সুরে বলছিলেন তিনি-- ফাতেমা খাতুন
ঈদ এলেই বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে বিশেষ পরিকল্পনা করে রাখতেন ময়মনসিংহের চিত্রসাংবাদিক হাসনাতুল ইসলাম মিল্লাত। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের চিন্তা ছিল ঈদের প্রথম শো-টা আমরা দেখব। কিন্তু তখন প্রচুর ভিড় থাকার কারণে আমরা একটা বিশেষ পন্থা অবলম্বন করতাম। আমরা একজনকে দিয়ে টিকিট আনানোর জন্য সিলেক্ট করে সবাই হুড়মুড় করে তাকে কাউন্টারে ঢোকানোর চেষ্টা করতাম।
কষ্ট ও মজার স্মৃতির কথা উল্লেখ করে এই সাংবাদিক বলেন, একদিন রাতে সিনেমা হল থেকে ফিরছিলাম। মিন্টু কলেজের সামনে রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একদল ছিনতাইকারী আমার পথ আটকায়। সেদিন ভোররাতেই আমার ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য। ঢাকা যাওয়ার খরচ ৫০০ টাকা ছিল আমার সঙ্গে। ছিনতাইকারীরা সেই টাকা নিয়ে যায়। পরে বন্ধুদের বাসায় গিয়ে চাঁদা তুলে আমি ঢাকা যাই।
দিন দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হলগুলো। নেই ভালো সিনেমাও, এমন আক্ষেপ করে তিনি বলেন, এখনো যখন যাই হলগুলোর সামনে দিয়ে, তখন কতশত স্মৃতি ভেসে ওঠে মনে। মনে পড়ে, আহ! আগে কত সুন্দর সুন্দর ছবি দেখতে আসতাম। তিনি বলেন, এখন আর দেখা হয় না, আগের সেই পরিবেশটাও নাই। কয়েকটা সিনেমা হল তো আর নেই, মার্কেট হয়ে গেছে। বাকিগুলো এখন মরা মরা। দেখে খারাপও লাগে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পালের বয়স যখন ১২ বছর, তখন থেকেই পারিবারিকভাবেই হলে গিয়ে সিনেমা দেখা শুরু হয় তার। বোন আর ভগ্নিপতি ঘটা করেই ছবি দেখতেন। সেই সুবাদেই সিনেমাপ্রেমিক হয়ে ওঠা তার।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপের সময় একটু নস্টালজিক হয়ে ওঠেন তিনি। ফিরে যান ষাটের দশকে। বলেন, ঈদ এলেই হলগুলোতে ভারতীয় সিনেমার পাশাপাশি পাকিস্তানি সিনেমা চলত। তখন এক হলের সঙ্গে আরেক হলের একরকম প্রতিযোগিতা থাকত যে কে বেশি হিট ছবি চালাতে পারে। তখন এত মানুষের চাপ ছিল যে সিনেমা হলে গিয়ে সহজে টিকিট পেতাম না। টিকিট কাটতে গিয়ে অনেক সময় হাতের কবজি মচকে গেছে। কখনো কখনো হাত কেটে গেছে, জামাও ছিঁড়ে গেছে।
বিমল পাল বলে চলেন, যিনি আমাদের দলনেতা থাকতেন, তাকে ৫-৬ জনের টাকা দিয়ে দিতাম। সে খুব শক্তি সঞ্চার করে টিকিট কাউন্টারে হাত ঢোকাত আর তাকে আমরা পাহারা দিয়ে রাখতাম যেন কেউ ঢুকে যেতে না পারে। এভাবেই দলবেঁধে সিনেমা দেখতাম। প্রাণভরে উপভোগ করে তৃপ্তি নিয়ে সিনেমা হল থেকে ফিরতাম। এরপর কয়েকটা দিন ছায়াছবির দৃশ্যগুলো স্মৃতিপটে ভাবনাবিলাসের রিল টেনে যেত।
১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত লোককাহিনিনির্ভর বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ‘রূপবান’ ময়মনসিংহের অলকা ও ছায়াবাণী হলে টানা ছয় মাস ধরে চলেছে। সেই সময়কার নানা ঘটনা এখনো চোখে ভাসে বিমল পালের। স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, এই সিনেমা দেখার জন্য বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল ছাড়া আশপাশের মানুষ বাস ভর্তি করে ময়মনসিংহে আত্মীয় বাড়ি উঠেছে। এলাকার ছেলেরা টিকিট কাটায় তাদের সহযোগিতা করেছে। পরে তারা সিনেমা দেখে, সবাই মিলে ঘোরাঘুরি করে তারপর তারা বাড়ি ফিরেছে। কি একটা যুগ ছিল তখন আহ!
দিন যত গড়াচ্ছে, সারাদেশের মতো ময়মনসিংহেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল। মার্কেট কিংবা আবাসিক ভবন গড়ে তোলার কারণে অস্তিত্ব হারিয়েছে সিনেমা হলগুলো। একসময় জেলায় ৪০টিরও বেশি সিনেমা হল থাকলেও বর্তমানে টিকে আছে মাত্র আটটি। এর মধ্যে আবার নিয়মিত রয়েছে মাত্র তিনটি হল।
এনএ