‘এত কম দাম কইলে, মাঠোত মরা নাগবে। ঈদের আগোত পটল বেচাইনো ৬০০ টাকা মণ। এ্যালা লকডাউনোত হাটোত সেই পটলের দামে নাই। কেজিপ্রতি ৭-৮ টাকা দাম। ৩০০ থাকি সাড়ে ৩৫০ টাকা মণে বিক্রি, তাও ফির গাহাক (ক্রেতা) নাই। হাটের অবস্থা খুবই খারাপ।’

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার জায়গীর হাটে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন কৃষক নজরুল ইসলাম। তার মতো জায়গীর হাটে সবজি বিক্রি করতে শত শত কৃষক অপেক্ষা করছেন। হাটে সবজির বেচাকেনায় ধস নেমেছে। বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতার অভাবে মিলছে না ন্যায্য দাম।

স্থানীয় সবজিচাষিরা জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা এই হাটে আসেন। কিন্তু ঈদের পর থেকে শুরু হওয়া লকডাউনে দূরদূরান্তের কোনো পাইকারের দেখা মিলছে না। সঙ্গে লকডাউনের অজুহাতে ভাড়া বাড়িয়েছে কৃষি পণ্যবাহী পরিবহনমালিক ও চালকেরা। এতে সবজি চাষে বিনিয়োগ করা পুঁজি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন চাষিরা।

সরেজমিনে মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) সকালে দেখা যায়, সকাল সাতটার দিকে জায়গীর স্বপনের মোড় থেকে ভ্যানে করে চার বস্তা বেগুন নিয়ে হাটে এসেছেন কৃষক আব্দুল মতিন। সকাল ১০টায় পর্যন্ত দুজন পাইকার তার বেগুন মণপ্রতি ১০০ থেকে ১৩০ টাকা দাম কষেছেন। কিন্তু একটু লাভের আশায় তখনো হাটে বসে আছেন বৃদ্ধ কৃষক।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে আব্দুল মতিন বলেন, ‘বাবা কায়ো মোর বাইগোনোর দাম করে না। এক-দেড় শ টাকা মণত বাইগোন (বেগুন) বেচা নাগেছ। কেজিতে আড়াই থাকি পৌনে চার টাকা পড়ে। এমন বাজার থাকলে আবাদ সুবাদ বাদ দেয়া নাগবে। কষ্ট করি আবাদ করি যদি ব্যাচপার আসি দামে না পাই, তাইলে বাঁচমো ক্যামন করি? সরকারোত কন, হামাক বাঁচাবার ব্যবস্থা করুক। লকডাউন তুলি দেউক।’

সবজিখ্যাত জায়গীর হাটে পাইকারি বাজার ঘুরে এমন আরও চিত্র দেখা গেছে। কৃষকদের দাবি, পাইকাররা তাদের কাছ থেকে প্রতি কেজি বেগুন ২ থেকে ৩ টাকা, কাঁকরোল ৪ থেকে ৫ টাকা, বরবটি ৬ থেকে ৮ টাকা, করলা ৩০ থেকে ৩৩ টাকা, পটল ৭ থেকে ৯ টাকা কেজি দরে কিনছেন।

ঈদের আগের বাজার দরের তুলনায় এখন প্রতি কেজি সবজিতে তিন থেকে সাত টাকা দাম কমেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এমন দরপতনে সবজিচাষিদের মাথায় হাত। তবে হাতবদল হয়ে খুচরা বাজারে আসা প্রতি কেজি সবজিতে আট থেকে পনেরো টাকার বেশি নিচ্ছেন বিক্রেতারা।

হাটের মাঝখানে কাঁকরোল, পটল, শসা, ঝিঙা নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন কৃষক আব্দুর রাজ্জাক। ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় হতাশ এ সবজিচাষি ঢাকা পোস্টকে বলেন, খেতোত পটল আবাদ করতে মণপ্রতি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পড়ে। এর সঙ্গে ভ্যানভাড়া, কামলা খরচও আছে। কিন্তু লাভের আশাত হাটোত আসি তো দাম পাওছি না। পাইকাররা ৩৬০ টাকা মণ কয়। ঝিঙা ও শসা ১০ টাকা কেজি। অথচ লকডাউন শুরুর আগোত বাজার ভালো গেইছে। তখন বিক্রি করা পত্তা (লাভ) হইছে। এ্যালা বাইরের পাইকার হাটোত নাই, ওই তকনে দামও নাই।

সবজিচাষি গোলাম মোস্তফা জানান, ঈদের আগের বাজার দরের সঙ্গে বর্তমান বাজারের কোনো মিল নেই। এখন কাঁকরোল প্রতি মণ ২০০ টাকা। অথচ ঈদের আগে বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা মণে। যে বরবটির এক সপ্তাহ আগে ৯০০ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, এখন তা ২৫০ টাকা মণ। পটল প্রতি মণে এখন ৩৫০ টাকা কম। অথচ ঈদের আগের হাটে ৭০০ টাকা মণ ছিল। করোলার দামও কমেছে। লকডাউন শুরুর আগে ১৬০০ টাকা মণে বিক্রি হলেও এখন তা ৬০০ টাকা কম।

এ ছাড়া জায়গীর হাটে পটল, ঝিঙা, ঢ্যাঁড়শ ১০ টাকা কেজি দরে, কাঁচামরিচ ৫০ টাকা, পেঁয়াজ ৪০ টাকা, কচুরলতি ২০ টাকা, বেগুন তিন টাকা, কাঁকরোল ৫ টাকা, পানিকুমড়া প্রতি পিচ ৮-১০ টাকা, দুধকুষি ৯ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। তবে এসব সবজি গ্রামের পাইকারি বাজার হয়ে শহরে ঢুকতেই বেড়ে যাচ্ছে দাম। একই সবজি রংপুর নগরের সিটি বাজার, কামালকাছনা, মুলাটোল ও ধাপ বাজারে ৫ থেকে ১৮ টাকা বেশি মূল্যে কিনছেন ক্রেতারা।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকাসহ রংপুরের ৮ উপজেলায় শাকসবজি আবাদ হয়েছে ৯ হাজার ৪৮০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৩৮৫ হেক্টর জমিতে শাকসবজির আবাদ বেড়েছে।

এর মধ্যে সবজি উৎপাদনখ্যাত মিঠাপুকুর উপজেলায় ২ হাজার ৮০ হেক্টর জমিতে শাকসবজির আবাদ হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা ট্রাকসহ পণ্যবাহী অন্য পরিবহনগুলোর সংকটের কারণে কোথাও ঠিকমতো সবজি পাঠাতে পারছেন না। এমনকি স্থানীয় হাটবাজারেও পণ্য সরবরাহ করতে ভ্যান, রিকশা বা অটোরিকশা ছাড়া অন্য কোনো পরিবহন-সুবিধা মিলছে না।

জায়গীর হাট কমিটির সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য মোকসেদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, কৃষকেরা খেত থেকে নিয়ে আসা সবজির দাম পাচ্ছেন না। লকডাউনের প্রভাবে সবজিচাষিরা কাঙ্ক্ষিত দামে বিক্রি করতে পারছেন না। বর্তমান পরিস্থিতি ও ট্রাক ভাড়া বাড়ার কারণে মিঠাপুকুর থেকে কোনো কাঁচামাল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় যাচ্ছে না। এখান বেকায়দায় পড়ে কম দামেই চাষিরা বিক্রি করছেন।

এনএ