বাজারে পড়ে আছে চামড়া, নেই ক্রেতা
দেশের অন্যতম বড় চামড়ার বাজার বসে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ এলাকায়। ময়মনসিংহ অঞ্চল ছাড়াও সিলেট, গাজীপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা চামড়া বিক্রি করতে আসেন এই বাজারে। ঈদ আসলেই প্রতি হাটে এখানে বিক্রি হয় লাখ লাখ পশুর চামড়া।
তবে এবার চিত্র যেন পুরোপুরি উল্টো। হাটের দিনেও কোনো ক্রেতা না আসায় পড়ে আছে অসংখ্য চামড়া। আর চামড়া বিক্রি করতে না পারায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন প্রান্তিক পর্যায়ের চামড়া ব্যবসায়ীরা।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) দুপুরে শম্ভুগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা মেলে এমন চিত্র। সারাবছর সপ্তাহের শনিবার এখানে চামড়ার হাট বসলেও ঈদের সময় হাট বসে শনিবার ও মঙ্গলবার। এবার প্রথম হাটে কেবল দুইজন ট্যানারি মালিকের প্রতিনিধি আসলেও দ্বিতীয় হাটে দেখা মেলেনি একজনকেও।
২৫ বছর ধরে চামড়া ব্যবসায় জড়িত শ্যামগঞ্জের রঞ্জিত রবিদাস। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এবার তিনি কিনেছেন এক হাজার ৬০০ গরুর চামড়া। কেনা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ বাবদ তার খরচ হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। তবে সেই চামড়া এখনো বিক্রি করতে না পেরে এখন তার মাথায় হাত।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে রবিদাস বলেন, ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা করে কেনা পড়েছে প্রতিটি চামড়া। সেই চামড়া মেরামত করতে প্রতিটির পেছনে খরচ পড়েছে আরও ২৫০-৩০০ টাকা। এখন চামড়া নিয়ে বসে আছি বাজারে। আজ হাটের দিন থাকলেও বাজারে কোনো ক্রেতাই আসেনি। এক সপ্তাহ পরপর লবণ দিতে হয়। এখন এভাবে পড়ে থাকলে তো খরচও বাড়বে। বাজারের যে অবস্থা তাতে, যে টাকা বিনিয়োগ করেছি সেই টাকা তুলতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।
কথা হয় আব্দুর রাজ্জাক নামে স্থানীয় আরেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৮৭ সাল থেকে শম্ভুগঞ্জ বাজারে চামড়া বেচা-কেনা হয়। তখন থেকেই আমার এই ব্যবসা। আগে আমরা বেশি দামে চামড়া কিনে বেশি দামেই বিক্রি করতে পারতাম। আগে ট্যানারিও বেশি ছিল। কিন্তু গত ৫-৭ বছর ধরে কমতে শুরু করেছে। আর এবার তো আসছেই না। বিক্রিও করতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, এখানে স্থানীয় ১৫ জন ব্যবসায়ী ছাড়াও বাইরে থেকে অনেকেই চামড়া নিয়ে এসেছেন। প্রথম হাটে বেশিরভাই বিক্রি করতে পারেননি। যে কয়েকজন বিক্রি করেছেন তারা তাদের চাহিদামতো দাম পাননি।
লক্ষাধিক টাকায় ২৫০ গরুর চামড়া কিনে সোমবার সুনামগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ বাজারে এসেছেন রাজু মিয়া। সঙ্গে এনেছেন তার ছেলে রাকিব মিয়াকেও। আশা ছিল, কিনে আনা চামড়াগুলো মঙ্গলবার বিক্রি করে লাভের মুখ দেখে ফিরবেন বাড়িতে। কিন্তু কোনো ট্যানারি মালিক না আসায় আগামী শনিবার পর্যন্ত এখানেই থাকতে হচ্ছে বাবা-ছেলেকে। তাই তাদের চোখে মুখে এখন হতাশার ছাপ।
রাজু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আড়াই শ চামড়া কেনা আর প্রক্রিয়াজাত করতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এখন যদি সরকার নির্ধারিত দামে এগুলো বিক্রি করতে না পারি তাহলে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করায় আমাদের এখন এই দুর্দশা। এ জন্যই হাটবারের দিনও কোনো ক্রেতা আসল না। তারা যাতে পরে আমাদের কাছ থেকে কম দামে চামড়া কিনতে পারে সেজন্যই এমনটা করছে।
রঞ্জিত কিংবা রাজু মিয়ার মতো দূর-দূরান্ত থেকে আসা আরও অনেক ফড়িয়া ব্যবসায়ী পড়েছেন এমন চরম বিপাকে। প্রতি বছর এই হাটে ১৫টির বেশি ট্যানারি মালিক বা তাদের প্রতিনিধি আসলেও এ বছর দু-একজন ছাড়া আগমন ঘটেনি কোনো ক্রেতার। আর অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় প্রথম হাটের পর ফেলে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১ লাখ ছাগলের চামড়া।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শম্ভুগঞ্জ চামড়ার হাটটিতে দায়িত্ব পালন করেন আসলাম হোসেন। বাজারের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হয় তার সঙ্গে। এ সময় তিনি বলেন, গত বছরও এই বাজারে প্রতি হাটে লক্ষাধিক চামড়া বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এবার সবচেয়ে বেশি মন্দা।
তিনি আরও বলেন, গত হাটে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩ হাজার চামড়া। এছাড়াও ১০০ ছাগলের দাম ৫০ টাকা বলায় বিক্রি হয়নি কোনো ছাগলের চামড়াই। সেগুলো বিক্রি না করে তারা হাটেই ফেলে চলে গেছে। পরে সিটি করপোরেশনের গাড়িতে করে হাট থেকে লক্ষাধিক ছাগলের চামড়া ময়লার স্তূপে ফেলা হয়।
উবায়দুল হক/এমএসআর