প্রতি দিন গড়ে ২০০ এর বেশি আক্রান্ত ও কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ জনের মৃত্যুর ঘটনার মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কর্মস্থলে ফিরে আসা লাখ লাখ শ্রমিককে নিয়ে শঙ্কিত শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দারা। বিশেষ করে করোনাযুদ্ধে থাকা বিভিন্ন সংগঠন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী-কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

শুক্রবার বিকেলে শিল্প কলকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসার পর অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যদিয়ে শিল্পাঞ্চলে ফিরেছেন কয়েক লাখ শ্রমিক। রোববার (০১ আগস্ট) সকালেও গণপরিবহনের পাশাপাশি ট্রাকে কিংবা পিকআপে চড়েও এসেছেন তারা।

তবে দেশের ৪০টির বেশি জেলা থেকে আসা এসব শ্রমিক পথে পথে স্বাস্থ্যবিধি মানেননি কিংবা মানার সুযোগও ছিল না। ফলে কাজে যোগ দিতে আসা কয়েক লাখ শ্রমিকের মধ্যে যদি ১ হাজার শ্রমিকও করোনার জীবাণু বয়ে নিয়ে এসে থাকেন, তবে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে সেটা অনুমান করাও ভয়ের বলে জানায় সাধারণ মানুষ।
 
এদিকে ২ দিনে নারায়ণগঞ্জে কাজে ফিরেছেন গার্মেন্ট ও শিল্প কারখানার কয়েক লাখ শ্রমিক। দেশের অন্যতম প্রধান রফতানি খাত নিট শিল্পের প্রধান কেন্দ্র ফতুল্লার বিসিকপল্লি এবং সিদ্ধিরগঞ্জের ইপিজেড, কাঁচপুর, রুপগঞ্জ, সোনারগাঁ, আড়াইহাজারে পুরোদমে চালু হয়েছে কমপক্ষে ১ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

তবে শ্রমিকরা বারবারই অভিযোগ করেছেন, প্রথমে গণপরিবহন বন্ধ রেখে কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল অনেকটাই হটকারী। তারা বলছেন, ১২ ঘণ্টার জন্য গণপরিবহন চালু করার সিদ্ধান্ত যদি আগে দেওয়া হতো কিংবা শ্রমিকদের কাজে যোগদানের এক দিন সময় দেওয়া হতো, তবে কষ্ট ও অর্থ দুটোই রক্ষা হতো তাদের।

যদিও মালিকপক্ষ বলছে, কঠোর লকডাউনের মেয়াদ তথা ৫ আগস্টের আগে কর্মস্থলে যোগ না দিতে পারলেও চাকরি হারানোর কোনো সুযোগ নেই শ্রমিকদের। এদিকে বারবার কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে কলকারখানা পরিচালনার কথা থাকলেও রোববার শ্রমিকদের মাঝে সেই সচেতনতার দেখা মিলেছে খুবই কম।

রোববার সকালে হাজার হাজার শ্রমিক গায়ে ঘেঁষে কারখানায় যাওয়ার দৃশ্য দেখে কোনো ক্রমেই বোঝার উপায় ছিল না দেশে কঠোর লকডাউন বা কঠিন করোনা পরিস্থিতি চলছে।
 
সরেজমিনে দেখা গেছে, নানা মাধ্যমে খবর পেয়ে কর্মস্থলে যোগ দিতে রোববারও মহাসড়ক দিয়ে ফিরছেন রাজধানীমুখী শ্রমিকরা। শনিবারের মতো হেঁটে নয়, বিভিন্ন পরিবহনের করে যাতায়াত করতে পেরেছেন তারা। তবে গাদাগাদি করে শত শত শ্রমিকের ফেরা ছিল স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা ছাড়াই।

সকালে ফতুল্লার বিসিক নিটপল্লিতে যোগ দিয়েছেন কমপক্ষে ২ লাখ শ্রমিক। এখানে ছোট বড় গার্মেন্ট কারখানার পাশাপাশি রয়েছে নিট ডাইং, ডাইং, নিটিং, প্রিন্টিংসহ ৬ শতাধিক শিল্পকারখানা।

অধিকাংশ শ্রমিকের অভিযোগ, কঠোর লকডাইন থাকায় গত শনিবার যানবাহন না পেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ট্রাক, পিকআপ ভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ইজিবাইক, রিকশা, ভ্যান এমনকি হেঁটে ফিরেছেন তারা।

‘যত মরা আমাগো ওপর দিয়া যায়, গরিবের লেইগ্যা খোদায়ও নাই’ কতটা ক্ষোভ আর দুর্ভোগ পোহানোর পর গার্মেন্টকর্মী মোমিনুল এমন মন্তব্য করেছেন সেটা সহজেই অনুমেয়।

গত শনিবার ৮ বছরের কন্যা শিশুটিকে নিয়ে মোমিনুল আর তার স্ত্রী মিলে বড় একটা ব্যাগ বয়ে এসেছেন প্রায় ৫ কিলোমিটার রাস্তা।
কিন্তু নরোববার তাকে কর্মস্থলে থাকতেই হবে, এমনটাই আদেশ পেয়েছিলেন তিনি।

ঝিনাইদাহ থেকে আসা গার্মেন্টশ্রমিক হাসিবুল ইসলাম জানান, ‘হঠাৎ করে যদি কেউ সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয় তাহলে তো কাজে ফেরা সম্ভব না। মালিকপক্ষের চাপে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিছে, লক্ষ লক্ষ শ্রমিক গ্রামে গেছে তাদের কথা চিন্তা করলেন না। শ্রমিকের অবস্থা চিন্তা না মালিকের কথা চিন্তা করেছেন। এই যে ভোগান্তি মানুষ আসা করে না।’

এদিকে কঠোর লকডাউনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নারায়ণগঞ্জে কয়েক লাখ শ্রমিকের যোগদানের বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলছে করোনা নিয়ে যুদ্ধ করা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।

নারায়ণগঞ্জ কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের (খানপুর ৩০০ শয্যা হাসপাতাল) সুপার ডা. আবুল বাশার জানান, যেহেতু সিদ্ধান্তটি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তাই এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না। কিন্তু কাজে যোগ দিতে আসা শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে আসতে পারেনি এটাই চরম সত্য।

নারায়ণগঞ্জের করোনা পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে এটাও সত্য। তাই এখন সবার আগে যে কাজটি করতে হবে, সেটি হলো শ্রমিকদের ফলোআপের মধ্যে রাখতে হবে। এ কাজটি শিল্প মালিকদের খুবই সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। কোনো শ্রমিক হঠাৎ জ্বর-ঠান্ডায় আক্রান্ত হলে তাকে পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

বিকেএমইএ-এর সিনিয়র সহসভাপতি (অর্থ) মোর্শেদ সারোয়ার সোহেল জানান, আমরা কিন্তু ঈদের আগেই বলেছিলাম শ্রমিকরা যেন দেশের বাড়িতে না যায়। এ জন্য ঈদের আগেই তাদের পাওনা বুঝিয়ে দিয়েছে মালিকরা। আমরা এখনও বলছি, যারা গ্রামে আছেন ৫ তারিখের পর এলেও তাদের চাকরি বহাল থাকবে।

এমএসআর