‘নৌকায় থাকা ১২ জন ব্যক্তিই লাশ। শুধুমাত্র নৌকার মাঝি ও আমি জীবিত। লাশগুলো নিয়ে ফিরছিলাম বাড়ির পথে। যেহেতু বজ্রপাতের ঘটনা, তাই সবাই যে মারা গেছে তা নিশ্চিত ছিলাম না। ঘণ্টা খানেকের কাছাকাছি সময় লেগেছে ভরা পদ্মা নদী পেরিয়ে অপর পাড়ে ফিরতে। এ সময় মহান আল্লাহর কাছে শুধু দোয়া করেছি। বারবার সবার চেহারার দিকে তাকিয়েছি। যদি কেউ কথা বলে অথবা নড়াচড়া করে। কিন্তু দীর্ঘ এক ঘণ্টা সময়েও কেউ সাড়া দেয়নি।’

বৃহস্পতিবার (০৫ আগস্ট) দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন গতকাল বুধবার (০৪ আগস্ট) চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বজ্রপাতের কবলে পড়ে বেঁচে ফেরা বৃদ্ধ মোফাজ্জল হোসেন (৬২)। তিনি বর আল মামুনের চাচাতো দাদা।

এর আগে বুধবার দুপুরে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাঁকা ঘাটে বজ্রপাতে বরপক্ষের ১৬ জন এবং স্থানীয় এক মাঝি ঘটনাস্থলেই মারা যান। বরপক্ষের মোট ৪৭ জন সদস্য পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে কনের বাড়িতে যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে। এছাড়াও বজ্রপাতের ঘটনায় আরও অন্তত ১২ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। 

ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী মোফাজ্জল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাঁকা গ্রামে বর-বউ আনতে যাচ্ছিলাম। পথে জোরে বৃষ্টি শুরু হলে দক্ষিণ পাঁকা ঘাটে নৌকা থামানো হয়। সেখানকার একটি ছাউনিতে আমিসহ যাত্রীরা আশ্রয় নিই। এরপর হঠাৎ করে বিকট শব্দে বজ্রপাত হয়। সবাই মাটিতে পড়ে যায়। পাশে ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, দেখলাম সেও পড়ে গেছে। বারবার আলম আলম করে চিৎকার করেও তার কোনো সাড়া না পেয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম।  

তিনি বলেন, আল্লাহর ইচ্ছাতেই বেঁচে ফিরেছি। বজ্রপাতের পর কিছুক্ষণ আমি অচেতন ছিলাম। কিছু সময় পর গ্রামের লোকজন এসে পড়ে থাকা সবাইকে উদ্ধার করে। গ্রামবাসীরা মরদেহগুলো নৌকায় উঠিয়ে দেয়। কিন্তু মরদেহের সঙ্গে কাউকে তো যেতে হবে। তেমন কেউই জ্ঞানে না থাকায় আমি নৌকায় উঠলাম। নৌকায় উঠানো হলো ১২টি মরদেহ। মরদেহগুলোর সঙ্গে শুধু আমি ও মাঝি।

তিনি জানান, ঘটনাস্থলেই সবাই মারা গেছিল। সব কিছু আমার চোখের সামনে হয়েছে। আশ্রয় নেওয়া ঘাটের ছাউনিতেই ১৭ জন মারা গেছিল। মরদেহগুলো সদর উপজেলার আলিমনগর ঘাটে নিয়ে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হাসপাতালে নিয়ে যান। আসলে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না বলেই হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম। আবার পরের নৌকায় নিয়ে আসা অজ্ঞান ব্যক্তিদের অনেকের জ্ঞান ফিরেছে। 

বজ্রপাতে নিহত ১৭ জন হলেন- সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা ঘাটাপাড়ার সাত্তার আলীর ছেলে সহবুল (৩০), চর সূর্যনারায়ণপুর গ্রামের টিপুর স্ত্রী বেলী বেগম (৩২), মহরাজনগর ডানপাড়ার জামালের ছেলে লেচন (৫০), রফিকুল ইসলামের ছেলে বাবলু (২৬), একই গ্রামের মৃত সৈয়ব আলীর ছেলে তবজুল (৭০), তবজুলের স্ত্রী জমিলা (৫৮), ছেলে সাদল (৩৫), তেররশিয়া দক্ষিণপাড়ার মৃত মহবুলের ছেলে রফিকুল (৬০), সূর্যনারায়ণপুরের ধুনু মিয়ার ছেলে সজিব (২২), একই গ্রামের সাহালালের স্ত্রী মৌসুমী (২৫), বাবুডাইংয়ের মকবুলের ছেলে টিপু (৪৫), কালুর ছেলে আলম (৪০), মোস্তফার ছেলে পাতু (৪০), সুন্দরপুরের সেরাজুলের ছেলে আতিকুল ইসলাম ডাকু (২৪), ফাটাপাড়ার সাদিকুলের স্ত্রী টকি বেগম (৩০),  জনতার হাট গ্রামের বাবুর ছেলে তামিম (৫) ও নৌকার মাঝি শিবগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ পাঁকা গ্রামের রফিকুল ইসলাম। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. নুরুন্নাহার নাসু ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোট ১১ জন মৃত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি আনা হয়েছিল। হাসপাতালে আনার আগেই তাদের মৃত্যু হয়। 

জাহাঙ্গীর আলম/আরএআর