মলিন মুখ। জীর্ণশীর্ণ চেহারা। পাক ধরেছে চুলে। বয়স চেনার উপায় নেই। কাকভেজা হয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) দুপুরে ব্যাগ হাতে বের হয়ে যাচ্ছিলেন রাজশাহী আঞ্চলিক শিক্ষা দফতর থেকে।

কথা হলো তা সঙ্গে। জানালেন জীবনের নানা গল্প। নাম তার আনোয়ারুল ইসলাম। বড় পরিচয় তিনি শিক্ষক। ২০ বছর ধরে জেলার তানোর উপজেলার দুবইল উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ওই পদে এমপিও না থাকায় তিনি এখন বর্গা চাষি। হারাতে বসেছেন তার শিক্ষক পরিচয়। দুই ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে নিদারুণ কষ্টের দিনযাপন করছেন।

জানা গেল, ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আনোয়ারুল ইসলাম তৃতীয়। বাবা আলতাব হোসেন ছিলেন কৃষক। তাদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের ইসলামপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীনারায়ণপুরে।

বিঘা সাতেক ধানি জমি থেকে সংসার চলতো তাদের। বাবা-ভাইদের সঙ্গে তিনিও কাজ করতেন খেতে। তাতে সংসারের চাকা সচল ছিল। তবে সর্বনাশা পদ্মার পেটে চলে গেছে সহায়-সম্বল। বাস্তুচ্যুত হয়ে ভাইয়েরা যে যার মতো ঠিকানা গড়েছেন। তিনিও থিতু হন তানোরের পাঁচন্দর ইউনিয়েনর যুগিশো এলাকায়। সরকারি খাস জমিতে গড়েছেন মাথা গোঁজার ঠাঁই।

১৯৯৯ সালে এলাকায় প্রতিষ্ঠা পায় দুবইল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তিনি সেখানে যোগদান করেন সহকারী শিক্ষক হিসেবে। ২০১০ সালে বিদ্যালয়টির নিম্ন মাধ্যমিক স্তর এমপিওভুক্ত হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালে মাধ্যমিক স্তরও এমপিওভুক্ত হয়। কিন্তু এমপিও বঞ্চিত রয়ে যান শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলাম।

তার ভাষ্য, সরকারি বিধি মোতাবেক ২০০৩ সালে তিনি সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পান। শুরু থেকেই ওই পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। এরই ফাঁকে ২০০৯ সালে তিনি পঞ্চম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সমাজবিজ্ঞান (সহকারী শিক্ষক) বিষয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০১১ সালের ৯ আগস্ট সরকারি বিধি মেনে মাধ্যমিক স্তরে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাকে সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) হিসেবে এমপিওভুক্তির আবেদন পাঠান প্রধান শিক্ষক। কিন্তু ডিগ্রি স্তরে ইংরেজি বিষয়ে তার প্রাপ্ত নম্বর ৩০০ না থাকায় সেই আবেদন বাতিল হয়ে যায়।

পরের দফা এমপিওতে তার আগের নিয়োগ সামনে এনে এমপিও আবেদন পাঠান প্রধান শিক্ষক। ফলে দুই দফা দুই রকম তথ্য দিয়ে আবেদন করায় সেইবারও তার আবেদন আটকে যায়।

অসহায় ওই শিক্ষক আরও জানান, তিনি একেবারেই ভূমিহীন। মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রীও অসুস্থ। সামান্য জমি বর্গা চাষ করে কোনো রকমে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগাড় করেন। সন্তানদের পড়া-লেখা, পরিবারের ভরণপোষণ টানা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

করোনা মহামারি সংকট বাড়িয়েছে আরও। তার দিন থমকে গেছে একেবারেই। পরিবার নিয়ে প্রাণে বাঁচতে এমপিওভুক্তির আকুতি জানিয়েছে এই শিক্ষক।

বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, শুরু থেকেই তিনি বিদ্যালয়টিতে দায়িত্ব পালন করছেন। মাধ্যমিক স্তরে তার সর্বশেষ নিয়োগ থাকায় নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে তাকে শিক্ষক হিসেবে দেখানো হয়নি। তার সেই নিয়োগের এমপিও শর্ত পূরণ না হওয়ায় বাতিল করে দেন আঞ্চলিক উপপরিচালক। পরের দফা তার আগের নিয়োগ সামনে এনে আবেদন করা হয়।

ওই নিয়োগের সময় এমন কোনো শর্ত ছিল না। কিন্তু দু-বার পৃথক আবেদনের কারণে সেটিও বাতিল হয়ে যায়। তার জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করেও কিছুই করতে পারেননি।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের রাজশাহীর উপপরিচালক ড. শরমিন ফেরদৌস চৌধুরী জানিয়েছেন, সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) হিসেবে এমপিওভুক্তির জন্য তার শর্ত পূরণ না হওয়া আবেদনটি বাতিল করা হয়েছে। এরপর তিনি পুরোনো নিয়োগ দেখিয়ে ফের এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। কিন্তু দুই বার দুই রকম তথ্য দিয়ে আবেদন করায় বিয়ষটি নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ওই শিক্ষক বিষয়টি নিয়ে এসেছিলেন। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের সুস্পষ্ট মতামত পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।

এসপি