ফাইল ফটো

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবি’র রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকার মালামাল আত্মসাতের মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে চাপা পড়ে রয়েছে। টিসিবির ইতিহাসে স্মরণকালের এই দুর্নীতি ধরা পড়লেও তদন্ত করার অনুমোদনে সায় মিলছে না দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক থেকে। গেল এক বছর ধরে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ওই মামলার অনুমোদন ফাইল আটকে আছে।

এদিকে অভ্যন্তরীণ অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের তথ্য প্রদানকারী টিসিবির রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী কার্যনির্বাহী মাহমুদুল হাসান রয়েছেন চরম বিপাকে। তার দাবি, ওই ঘটনার পর থেকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো ছাড়াও প্রভাবশালী মহল থেকে কিছু দৃশ্য-অদৃশ্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সম্প্রতি তাকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান। 

এ ঘটনায় নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে গত শনিবার (১৪ আগস্ট) রংপুর কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন মাহমুদুল হাসান।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, টিসিবির রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অথবা মধ্যবর্তী কোনো এক সময় বা একাধিক সময়কালে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হয়। ওই সময়ে প্রতারণার মাধ্যমে স্বল্পমূল্যের চিনি, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, ছোলা ও পেঁয়াজ আত্মসাৎ করেন তৎকালীন অফিস প্রধান সুজা উদৌলা সরকার।পূর্বপরিকল্পিত ও যোগসাজোসে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে এ ধরণের জালিয়াতি, প্রতারণা ও চুরির ঘটনার মাধ্যমে দুই কোটি চুয়ান্ন লাখ একাশি হাজার তিনশত টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া যায়।

২০২০ সালের এপ্রিলে টিসিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার হাসান জাহাঙ্গীরের বিশেষ নিদের্শনায় সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধের নিমিত্তে কাজ করেন সহকারী কার্যনির্বাহী মাহমুদুল হাসান। ওই বছরের ১১ মে টিসিবির চেয়ারম্যানকে কিছু দুর্নীতি ও অনিয়মের সুনিদিষ্ট তথ্য দেয়া হয়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে কয়েক দফা তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলে তৎকালীন টিসিবির রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যানির্বাহী (অফিস প্রধান) মো. সুজা উদৌলা সরকারকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত দেখানো হয়। বর্তমানে সুজা উদৌলা সরকার ঢাকায় টিসিবির প্রধান কার্যালয়ে উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যানির্বাহী পদে রয়েছেন।

ভয়াবহ এই অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় গত বছর তিনজনের নাম উল্লেখ করে কোতোয়ালি থানায় একটি এজাহার দায়ের করেছেন টিসিবির রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের বর্তমান উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যনিবার্হী (অফিস প্রধান) প্রতাপ কুমার। এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন, রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সাবেক উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যানির্বাহী মো. সুজা উদৌলা সরকার, সংরক্ষণ ও বিক্রয় সহকারী এবং সাবেক গুদাম কর্মকর্তা মো. মেসবাহুস সালেহীন ও মজুরিভিত্তিক নিরাপত্তা প্রহরী মো. মোফাজ্জল হোসেন।

তাদের বিরুদ্ধে পারস্পারিক পূর্ব পরিকল্পনা ও যোগসাজসে গুদাম থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত বিধিবহির্ভূতভাবে টিসিবির লোগো সম্বলিত মসুর ডাল অন্যত্র সরিয়ে বিক্রয় করার অভিযোগ রয়েছে। 

এজাহারে বলা হয়েছে, অন্য ব্র্যান্ডের মসুর ডাল গুদামে ঢুকিয়ে মজুদ ও সাময়িক সংরক্ষণ করেছেন তারা। ৬৬ বস্তা অন্যান্য ব্রান্ড্রের মসুর ডাল অসৎ উদ্দেশ্যে টিসিবির লোগো সম্বলিত বস্তায় ঢুকিয়ে গুদামে রাখা হয়। গুদামের চাবি গুদাম ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী গুদাম কর্মকর্তার কাছে বা অফিস প্রধানের কাছে না রেখে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিরাপত্তা প্রহরীর (দৈনিক মজুরি ভিত্তিক) কাছে রাখা হয়। শুধু তাই নয়, গুদামে মজুদ রাখা চিনি, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, ছোলা এবং পেঁয়াজ পণ্য ঘাটতি রয়েছে। সবমিলিয়ে যার মোট মূল্য দুই কোটি চুয়ান্ন লাখ একাশি হাজার তিনশত চৌত্রিশ দশমিক শূন্য আট টাকা।

বিভিন্ন সময়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংঘটিত অপরাধের তথ্য প্রমাণ অদৃশ্য করতে পরিকল্পিতভাবে সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কখনো বা সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। এ কার্যালয়ে কর্মরত অফিস প্রধান থেকে শুরু করে অধঃনস্ত কর্মচারীদের মধ্যে চেইন ইন কমান্ড, নিয়মশৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পরায়ণের বিশাল ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে, যা রীতিমত শৃঙ্খলা বিরোধী ও অনিয়ম কর্মকাণ্ডের আওতাভুক্ত।

সম্প্রতি টিসিবির রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে সহকারী কার্যনির্বাহী মাহমুদুল হাসানের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি ও ট্রাকচাপায় তাকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগ উঠলে আলোচনায় আসে সুজা উদৌলা সরকারের পৌনে তিন কোটি টাকার অনিয়ম দুর্নীতির মামলাটি। সুজা উদৌলা রংপুরে থাকাকালীন সময়ে মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে অনেক ডিলারের বাসা বাড়ি ও গুদাম থেকে অবৈধভাবে মজুদ করে রাখা টিসিবির বিপুল পরিমাণ মালামাল উদ্ধার হয়েছিল। এরমধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা খাটের নিচে তেলের খনি! ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল এক ব্যবসায়ীর বাড়ির বক্স খাটের নিচ থেকে এক হাজার ২৩৮ লিটার ভোজ্যতেল উদ্ধার হয়। যার সঙ্গে সুজা উদৌলা সরকারের কালোবাজারি চক্র ও টিসিবির তালিকাভুক্ত ডিলার জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে মাহমুদুল হাসানের জিডির ব্যাপারে রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রশিদ বলেন, আমরা ঘটনাটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখছি। পূর্বের বিভিন্ন সময়ের অভিযোগ ও বর্তমান ঘটনার সত্যতা মিললে সাধারণ ডায়েরিটি (জিডি) হত্যা মামলায় রুপান্তরিত হবে।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবির) রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী কার্য নির্বাহী মাহমুদুল হাসান বলেন, ২০২০ সালে
রংপুর অফিসে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধে কাজ করছি। আমার তথ্যের ভিত্তিতে সুজা উদৌলা সরকারের সময়ে সংঘটিত বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি আমলে নেন প্রধান কার্যালয়। ওই সময়ে ঢাকা থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।

এরপর ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবির) রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের বর্তমান উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যানির্বাহী (অফিস প্রধান) প্রতাব কুমার বাদী হয়ে মো. সুজা উদৌলা সরকারসহ তিনজনকে আসামি করে ২ কোটি ৫৪ লক্ষ ৮১ হাজার ৩০০ টাকা আত্মসাতের এজাহার রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানায় দায়ের করেন। রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানা মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে পাঠায়।  

এ ব্যাপারে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের রংপুরের উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, মামলাটি তদন্ত করার জন্য অনুমোদন চেয়ে গত বছর দুদক প্রধান কার্যালয়ে আবেদন করা হয়েছে। এখনো অনুমোদন পাওয়া যায়নি। কিন্তু এক বছর ধরে কেন অনুমোদন আটকে আছে, এমন প্রশ্ন করলে তিনি ঢাকায় যোগাযোগ করতে বলেন।

মামলার কেন অগ্রগতি নেই, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টিসিবির রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-ঊর্ধ্বতন কার্যনিবার্হী (অফিস প্রধান) প্রতাপ কুমার বলেন, আমরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সত্যতার ভিত্তিতে মামলা করেছি। বর্তমানে মামলাটি দুদকে রয়েছে। এ মামলার অগ্রগতি নিয়ে দুদকই ভালো বলতে পারবে। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারব না।

এমএএস