না-বলা কত কথা জমে ছিল আমাদের
অনেক দিন পরে স্কুলে এসে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছি, কথা বলছি। এত দিনের না-বলা কত কথা জমে ছিল আমাদের। এত ভালো লাগছে যে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে করোনার আগে আমরা যেমন একসঙ্গে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস করতে পেরেছি। এখন তা পারছি না। অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস হচ্ছে। তারপরও যে ক্লাস হচ্ছে, তাতেই আমরা খুশি। এভাবেই কথাগুলো বলছিল বাগেরহাট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আনিকা।
বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাতেমাতুজ্জোহরা ইমা বলে, খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেছে। রাতেই রেডি করে রাখা স্কুল ব্যাগ ও বই নিয়ে আম্মুর সঙ্গে স্কুলে এসেছি। অনেক দিন পর স্কুলে এসে আমার খুব ভালো লাগছে। স্যাররাও আমাদের অনেক আদর করেছেন। শুধু আনিকা বা ইমা নয়। এমন খুশির ঝলক ছিল জেলার সব শিক্ষার্থীর মুখে।
বিজ্ঞাপন
বিদ্যালয়গুলোর আয়া ও দপ্তরিদের মধ্যেও ছিল শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস। বালিকা বিদ্যালয়ে কথা হয় আয়া শিল্পি আক্তারের সঙ্গে। পরিচ্ছন্ন ঘণ্টাটি বারবার মুছছেন, হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আবার একা একা হাসছেনও। জিজ্ঞেস করতে একটু লজ্জা পেয়েই বললেন, কতদিন এই ঘণ্টার শব্দ কানে আসেনি। বাচ্চাদের ছোটাছুটি চোখে পড়েনি। এরাই তো আমার পরিবার।
বিদ্যালয়ের বাইরে রকমারি খাবারের পসরা নিয়ে বসে থাকা শিশুদের ঝালমুড়ি মামার মধ্যেও ছিল বাঁধভাঙা আনন্দ। তিনি বলেন, দেড়টা বছর বাচ্চাদের খাওয়াই না। তাই বেশি বেশি করেই দিচ্ছি আজ।
বিজ্ঞাপন
৫৪৪ দিন পরে স্কুলে আসতে পেরে খুশি বাগেরহাটের শিক্ষার্থীরা। রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসেছেন তারা। প্রতিটি স্কুলে উচ্ছ্বসিত ছিল শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন পর সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পেরে খুশি হয়েছেন অভিভাবকরাও। শিক্ষকরাও খুশি শিক্ষার্থীদের পেয়ে। নির্ধারিত সময় শেষে বাড়ি ফিরেছেন তারা।
জেলার বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন। অন্যান্য সময়ের মতো একে অপরের কাঁধে হাত অথবা কোলাকুলির দৃশ্য না থাকলেও শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে ছিল অন্যরকম এক আনন্দ অনুভূতির ছোঁয়া।
বিদ্যালয়ের গেটের সামনে সন্তানের জন্য অপেক্ষারত অভিভাবক ছবি ইসলাম বলেন, এতদিন স্কুল বন্ধ থাকায় সন্তানদের নিয়ে একধরনের চিন্তায় ছিলাম। সকালে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে এসেছি, খুব ভালো লাগছে। এখন একটু চিন্তামুক্ত হলাম।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে ব্যতিক্রম আয়োজন দেখা গেছে মোংলার ঐতিহ্যবাহী সেন্ট পলস্ উচ্চবিদ্যালয়ে। দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা ও পরিবেশে ফুল দিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিয়েছে বিদ্যালয়টি। শিক্ষার্থীদের আগমনকে ঘিরে বিদ্যালয়টির প্রাচীর, গেট ও ভবনগুলো ব্যানার, ফুল এবং বেলুন দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে। স্কুলের প্রবেশপথে 'ওয়েলকাম ব্যাক টু স্কুল' লেখা সংবলিত বিশাল আলপনাও করা হয়েছে।
বাগেরহাট সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চিত্তরঞ্জন পাল বলেন, প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সন্তোষজনক। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষার জন্য আমরা স্যানিটাইজসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছি। একসঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীর পাঠদান আমরা বন্ধ রেখেছি। শিফট অনুযায়ী অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর পাঠদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সেন্ট পলস উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ব্রাদার জয়ন্ত এন্ড্রু কস্তা বলেন, সব নিয়ম মেনেই আমরা শিক্ষার্থীদের গ্রহণ করছি। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েই শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। অনেক দিন তাদের অনুপস্থিতি আমাদের উভয়ের মাঝে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। তাই তাদের বরণ করতে নানা আয়োজন রয়েছে আমাদের। আমাদের এ আয়োজনে তারা ভীষণ খুশি ও আনন্দিত হয়েছে।
বাগেরহাট জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান শুরু করেছি। সকাল থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছি। সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান করছেন। পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
তানজীম আহমেদ/এনএ