চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের ডাক্তারপাড়া গ্রামের এনামুল হক (৫০) ইউনিয়ন পরিষদ থেকে নিজের স্ত্রীর ও ছেলের জন্মনিবন্ধন করেছেন। তিনটি জন্মনিবন্ধন করতে দিনমজুর এনামুলকে গুনতে হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা। এর মধ্যে বয়স প্রমাণের জন্য এমবিবিএস চিকিৎসকের প্রত্যয়ন নিতেই দিতে হয়েছে ৯০০ টাকা।

একই গ্রামের বদিউজ্জামান (৬০) তার ছেলে আহাতারের জন্য জন্মনিবন্ধন করেছেন। চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের জন্য তার কাছ থেকেও নেওয়া হয়েছে ৫০০ টাকা। শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয় রাজিবুল ইসলাম বাবুকে টাকা দিয়ে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন বদিউজ্জামান।

মো. মোজাম্মেল হকের স্ত্রী রোজিনা বেগম জানান, বড় ছেলের জন্মনিবন্ধন ফি মাত্র ৮৫ টাকা হলেও ছোট ছেলের বেলায় তা হয়েছে ৪৫০ টাকা। ডাক্তার খরচ, ট্র্যাক্স সব মিলিয়ে এই টাকা নেওয়া হয়েছে বলে তাকে জানায় ইউনিয়ন পরিষদ।

গৃহবধূ জলি খাতুন বলেন, শুধু খরচের বিষয় বিবেচনা করে দুই ছেলের জন্মনিবন্ধন করছি না। কারণ রাজমিস্ত্রি স্বামীর পক্ষে এত ব্যয় বহন করা সম্ভব না। শুনেছি কারও কাছে ৫০০ টাকা, কারও কাছে ৩০০ টাকা ডাক্তারের ফিসহ বিভিন্ন খরচ নিচ্ছে। তাই আর জন্মনিবন্ধন করতে যায়নি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ প্যারাডাইস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালন্টেশন সেন্টারের চিকিৎসক রুবেল আহমেদের সঙ্গে এই প্রতিবেদক নিজেকে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা পরিচয়ে ৭৭টি প্রত্যয়নপত্র করতে চাইলে প্রতিটির জন্য রুবেল ৩০০ টাকা করে দাবি করেন। এ বিষয়ে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড রয়েছে প্রতিবেদকের কাছে। তার চেম্বারে দেখা করে সাংবাদিক পরিচয় জানতে পারলে এ বিষয়ে কথা না বলে চলে যান।

শুধু চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র নিতেই ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা ব্যয় হয় পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের জনসাধারণের। পদ্মা পাড় ও চরাঞ্চলের এসব নিম্ন আয়ের মানুষের সরলতার সুযোগে প্রত্যয়নপত্রের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান চিকিৎসকরা।

চিকিৎসা না দিয়েই শুধু প্রত্যয়নপত্রের একটি স্বাক্ষরেই মিলছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। এই কাজে যুক্ত রয়েছেন সরকারি হাসপাতালের দুই চিকিৎসক, অফিস সহকারী, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা, হাসপাতালের ওয়ার্ড বয়।

স্থানীয় বাসিন্দা, গ্রাম পুলিশ, ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা, ইউপি সদস্য সূত্রে জানা যায়, ইউপি চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীনের আমন্ত্রণে চলতি বছরের ২২ মে ইউনিয়ন পরিষদে আসেন রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের সাবেক মেডিকেল অফিসার এবং বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ প্যারাডাইস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালন্টেশন সেন্টারের চিকিৎসক রুবেল আহমেদ। সেদিন ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়েই শতাধিক প্রত্যয়নপত্র দেন তিনি। জনপ্রতি নিয়েছেন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। পরে এভাবে পরিষদে চিকিৎসক এনে টাকার বিনিময়ে সনদ দেওয়া ক্ষোভে প্রতিবাদ করেন স্থানীয়রা।

এরপর থেকে দুটি গ্রুপের মাধ্যমে টাকা দিয়ে প্রত্যয়নপত্র নিচ্ছে ইউনিয়নবাসী। একটি গ্রুপে রয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা সুজন। প্রতিটি প্রত্যয়নের জন্য ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা তোলেন তিনি। এরপর তার মাধ্যমে এসব প্রত্যয়ন গ্রহণ করেন রুবেল আহমেদ।

আরেকটি গ্রুপে টাকা নেন পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই বাড়ি ও শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয় রাজিবুল ইসলাম বাবু ও অফিস সহকারী আল-আমিন। তারা শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুই চিকিৎসক ডা. কামাল ও ডা. সুইটের মাধ্যমে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করেন তারা।

বিষয়টি স্বীকার করে ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা সুজন বলেন, পরিষদে চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের জন্য কোনো টাকা নেওয়া হয় না। অনেকেই বাইরে থেকে কাউকে টাকা দিয়ে এটি করতে পারে।

তবে পাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জালাল উদ্দীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ওয়ার্ড বয় রাজিবুল ইসলাম বাবু জানান, টাকা নিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দুই চিকিৎসক ডা. কামাল ও ডা. সুইটের মাধ্যমে প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এখন থেকে নতুন নিয়মে কোনো প্রকার টাকাপয়সা ছাড়াই প্রত্যয়ন দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রত্যয়নপত্রগুলো সরকারি হাসপাতালে নয়, প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে নেওয়া হয় বলে জানান ওয়ার্ড বয় রাজিবুল ইসলাম বাবু ও অফিস সহকারী আল-আমিন।

শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সুইট বলেন, আগে টাকা নেওয়া হতো। তবে এখন প্রত্যয়নপত্রে কোনো টাকা নেওয়া হয় না।

এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ প্যারাডাইস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালন্টেশন সেন্টারের চিকিৎসক রুবেল আহমেদের সঙ্গে এই প্রতিবেদক নিজেকে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা পরিচয়ে ৭৭টি প্রত্যয়নপত্র করতে চাইলে প্রতিটির জন্য রুবেল ৩০০ টাকা করে দাবি করেন। এ বিষয়ে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড রয়েছে প্রতিবেদকের কাছে। তার চেম্বারে দেখা করে সাংবাদিক পরিচয় জানতে পারলে এ বিষয়ে কথা না বলে চলে যান।

সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে জন্মনিবন্ধনের জন্য নাগরিকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়ে চিকিৎসকদের বিধিনিষেধ দেওয়া আছে। তবে প্রাইভেট ক্লিনিক বা চেম্বারে টাকা নিলে এ বিষয়ে আমাদের কিছু করণীয় নেই।

তবে চিকিৎসা না দিয়ে শুধু প্রত্যয়ন দিয়ে টাকা নেওয়ার বিষয়টি কতটুকু নৈতিক, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রাইভেট ক্লিনিক বা চেম্বারে চিকিৎসা দিয়ে টাকা নিতে পারে। কিন্তু শুধু প্রত্যয়নপত্র দিয়েই টাকা নেওয়াটা সঠিক কাজ নয়।

মো. জাহাঙ্গীর আলম/এনএ