যে বয়সে অন্য মেয়েদের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনা করার কথা ছিল তার, সে বয়সে তাকে বসে থাকতে হয় ঘরের কোণে। একসময় তারও বড় হওয়া স্বপ্ন ছিল। এখন সব স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেছে। কারণ, ক্রমেই মানসিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে তার। তাই বাধ্য হয়ে তার বাবা তাকে শিকলবন্দি করে রেখেছেন।

দীপা সূত্রধর (১৮)। টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বীরবাসিন্দা ইউনিয়নের কস্তুরিপাড়া বৃদ্ধ দীনেশ সূত্রধরের মেয়ে তিনি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর একদিন টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে শুরু হয় মানসিক সমস্যা। তারপর হয়ে যান মানসিক প্রতিবন্ধী। কিছুদিন চিকিৎসা করালেও শারীরিক কোনো পরিবর্তন হয়নি।

শুধু দীপাই নন, তার ভাই দীপন (৩৫) ও তার মা-ও মানসিক ভারসাম্যহীন বা প্রতিবন্ধী হিসেবে জীবনযাপন করছেন। তবে এক পরিবারে তিনজন মানসিক প্রতিবন্ধী থাকলেও তাদের কপালে জোটেনি সরকারি কোনো ভাতার কার্ড।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কালিহাতী-বড়চওনা সড়কের পাশে উপজেলার কস্তুরিপাড়া এলাকায় বৃদ্ধ দীনেশ (৭৬) সূত্রধর তার মানসিক প্রতিবন্ধী স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের জন্য রান্না করছেন। পেশায় কাঠমিস্ত্রি দীনেশ বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাই এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। সড়কের পাশে জরাজীর্ণ টিনের একটি ঘর ৮০০ টাকা ভাড়া নিয়ে কোনো রকমে প্রতিবন্ধী স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন।

একমাত্র মেয়েটিকে ঘরের একটি কক্ষে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। চিকিৎসা করানোর পর দুই-তিন মাস হলো ছেলে কিছুটা সুস্থ হয়েছে। তবে প্রতিদিনই তিনজনকে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। দীনেশ সূত্রধর ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালান। তাই মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন।

জানা গেছে, এইচএসসি পাস করা কাঠমিস্ত্রি দীনেশ সূত্রধর ১৯৭৪ সালে বিয়ে করেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার করটিয়া এলাকার সুবল সূত্রধরের মেয়ে পারুল সূত্রধরকে। পরবর্তী সময়ে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে দীনেশ করোটিয়ায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। তার অধীনে বেশ কয়েকজন কাঠমিস্ত্রি কাজ করতেন। সংসারও বেশ ভালোভাবে চলছিল। তাদের দুটি ছেলে হওয়ার পর প্রায় ২০ বছর আগে দীনেশের স্ত্রীর টাইফয়েড দেখা দেয়। এতে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

এরপর সাত বছর বয়সে বড় ছেলে দীজেন সূত্রধর নেশায় আসক্ত হয় পড়েন। একসময় ভারসাম্য হারান। পরে তাকে লোহার শিকলে বেঁধে রাখা হয়। একদিন শিকল ভেঙে পালিয়ে যান। আজ পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাননি তার পরিবার। এরপর ২০০২ সালে জন্ম হয় দীপা সূত্রধরের। দীপা যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করেন, তখন তার টাইফয়েড জ্বর হয়। এরপর থেকেই দীপা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তবে প্রায় পাঁচ বছর ধরে দীপাও শিকলবন্দি অবস্থায় আছেন।

তারপর ২০১৬ সালে দীনেশ সূত্রধর নিজ এলাকা কালিহাতীর বীরবাসিন্দার কস্তুরীপাড়া এলাকায় চলে আসেন। এখানে আসার পরই দীনেশের আরেক ছেলে দীপন সূত্রধর এক বছর আগে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাকেও শিকলবন্দি করে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন। তবে স্থানীয়দের সাহায্য-সহযোগিতায় দীপনের চিকিৎসা করানো হলে বর্তমানে কিছুটা তিনি কিছুটা সুস্থ আছেন।

বৃদ্ধ দীনেশ বলেন, একসময় আমার সবই ছিল। কিন্তু বর্তমানে কিছুই নেই। টাকার অভাবে স্ত্রী-সন্তানদের চিকিৎসা করাতে পারি না। ঠিকমতো তিন বেলা খাবারও জোটে না। স্থানীয়রা সাহায্য না করলে না খেয়ে মরতে হতো আমাদের। পরিবারের তিনজন ‘পাগল’ (শারীরিক অসুস্থ)। বৃদ্ধ বয়সে এখন আর কাঠের কাজ করতে পারি না। ফলে ‘পাগলদের’ দেখাশোনা করতে করতে নিজেও মানসিক রোগীতে পরিণত হচ্ছি। বাড়ির রান্নাবান্না আমাকেই করতে হয়। সরকারিভাবে কোনো ভাতা বা সহায়তা পাইনি।

কস্তুরীপাড়ার স্থানীয়রা বলেন, দীনেশের স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ে তিনজনই মানসিক প্রতিবন্ধী। স্থানীয়রা মিলে টাকা সংগ্রহ করে তার ছেলের মানসিক চিকিৎসা করানো হয়। বর্তমানে ছেলেটা কিছু সুস্থ হলেও মেয়েটা শিকলেই বাঁধা রয়েছে। ঠিকমতো খাবারই খেতে পারেন না, সেখানে স্ত্রী-সন্তানদের চিকিৎসা করাবেন কীভাবে? এলাকার অনেক ধনী মানুষও সরকারি বয়স্ক ভাতার কার্ড পেয়েছে। কিন্তু এই অসহায় মানসিক ভারসাম্যহীন পরিবারগুলো সরকারি কোনো সহায়তা পায় না। একটি জরাজীর্ণ ঘরে দীনেশ তার পরিবার নিয়ে বসবাস করে।

বীরবাসিন্দা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন বলেন, পরিবারটি এর আগে করোটিয়ায় ছিল। পরিষদ থেকে এর আগে চাল দেওয়া হয়েছিল। চার সদস্যের পরিবারের তিনজনই মানসিক প্রতিবন্ধী। নতুন বরাদ্দ এলেই তাদের প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বিষয়টি জানা ছিল না। আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। প্রতিবন্ধী বা বয়স্ক ভাতার কার্ডের জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা তালিকা দেয়। সেখানে তাদের নাম দেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে তাদের নামে ভাতার কার্ড চালুর বিষয়ে উপজেলা মিটিংয়ে উপস্থাপন করা হবে।

জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গণি বলেন, কালিহাতীতে একটি পরিবারে তিন সদস্য প্রতিবন্ধী এবং তারা আর্থিকভাবে সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব। কিন্তু তারা প্রতিবন্ধী ভাতা বা অন্যান্য সরকারি সহায়তা পান না বলে জানতে পেরেছি। খোঁজ নিয়ে অতিদ্রুত তাদের প্রতিবন্ধী ভাতার প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা করা হবে।

তাদের আবাসনের দরকার হলে জেলা প্রশাসন থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর প্রদান করা হবে। এ ছাড়া তাৎক্ষণিক সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।

এনএ