১০১ কক্ষবিশিষ্ট এক জমিদারবাড়িতে সন্ধ্যা নেমেছে। বসেছে নাচগানের আসর। রাত যত বাড়ছে, জমিদারবাড়ির ঢোলের বাদ্য ততই স্পষ্ট হচ্ছে। একটা সময় সবই থেমে গেছে হঠাৎ নিভে যাওয়া প্রদীপের মতো। নরসিংদী সদর উপজেলার মাধবদী থানাধীন পাইকারচর ইউনিয়নে অবস্থিত বালাপুর জমিদারবাড়ির দৃশ্যটা এমন। অথচ কালের বিবর্তনে বাড়িটি আজ পরিণত হয়েছে ভাগাড়ে।

তবে এখনো দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ, নকশা ইত্যাদির মাঝে গন্ধ লুকিয়ে আছে আভিজাত্যের। আছে দুই পুরুষের জমিদারির ছোঁয়া। রাজধানী ঢাকা থেকে খুব কাছে হওয়ায় প্রতিদিনই এখানে ছুটে আসছেন পর্যটকরা।

জানা যায়, বালাপুর জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা জমিদার বাবু নবীনচন্দ্র সাহা। তার ছিলেন তিন ছেলে— কালীমোহন সাহা, আশুতোষ সাহা ও মনোরঞ্জন সাহা। বাবা জমিদার নবীন চন্দ্র সাহা মারা যাওয়ার পর বড় ছেলে কালীমোহন সাহা জমিদার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তবে কবে নাগাদ এই জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়, তা খুঁজে বের করা যায়নি।

প্রায় ৩২০ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই বাড়িতে রয়েছে একটি একতলা ভবন, একটি দোতলা ভবন ও একটি তিনতলা ভবন। এখানে সব মিলিয়ে কক্ষ রয়েছে ১০১টি। রয়েছে একটি মন্দির, দুর্গাপূজার মণ্ডপ ও একটি পুকুর। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হলে তারা তাদের জমিজমা এই বাড়িতেই অবস্থিত রাধাকৃষ্ণ মন্দির নামে একটি মন্দিরকে উইল করে দিয়ে দেশ ছাড়েন। কিছুদিন পর ফেরার কথা থাকলেও আর ফেরেননি জমিদারের বংশধররা।

সরেজমিনে দেখা যায়, ১০১ কক্ষের যতগুলোয় প্রবেশ করা যায়, প্রায় সব কটিতেই খসে পড়ছে দেয়ালের কারুকাজ। সিঁড়ি, কার্নিশ ও মেঝেতে বাসা বেঁধেছে শেওলা, জমে আছে আবর্জনা। শেওলা ও পাতাবাহার বংশবিস্তার করে পৌঁছে গেছে ভবনের ছাদ পর্যন্ত। সিমেন্ট বা সুড়কির আস্তরণ ভেদ করে পুরোনো আমলের ইটও দেখা যাচ্ছে।

নিচতলার কক্ষগুলোর বেশির ভাগেরই গ্রিল ও দরজা নেই। যেগুলোতে দরজার কপাট ও জানালার আবরণ আছে, সেগুলোতে বাস করছে একদল পুণ্যার্থী। তারা এই বাড়ির ভেতরেই এক মন্দিরে কাজ করে। একসময় বাড়িজুড়েই থাকতেন তারা। ২০১৪ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধ্বংসের পর দোতলা ও তিনতলা থেকে তাদের নামিয়ে ওপরে ওঠা সম্পূর্ণ নিষেধ করে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে তালাবদ্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন।

এরপর থেকে তারা আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতে ভাড়া করে থাকেন। কেউ কেউ নিচতলার কয়েকটি রুমে থাকছেন এখনো। তবে বাড়ির পাশে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে নিয়মিত হচ্ছে পূজা, মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমও চলে এখানে।

জমিদারবাড়িটিতে থাকতেন ওসিত কুমার সাহা (৫৫) নামের একজন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা এখানে থাকতেন। এই বাড়ির ভেতরে অবস্থিত রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে কাজ করতেন। আমার ছোটকাল, মধ্য বয়স এই বাড়িতেই কেটেছে। ২০১৪ সালে সরকার ঝুঁকিতে আছে এমন ধারণা করে এখানে বাস করা প্রায় ২০টি পরিবারকে নামিয়ে দেয়।

রাধাকৃষ্ণ মন্দিরের দেখাশোনা করেন গোপাল আচার্য নামের একজন। তিনি বলেন, আগে অনেক পরিবারই ভেতরে থাকত। এখন দুই-তিনটা পরিবার থাকে কোনোরকমে। আর পুরো বাড়ির অবস্থা খারাপ। মন্দিরের জন্য মাঝেমধ্যে কিছু সহায়তা এলেও বাড়িটি যেন দেখার কেউ নেই।

শান্ত ঘোষ নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ফেসবুক থেকে এই বাড়ির কথা জানতে পেরে আমি দেখতে এসেছি। দেখে খুব ভালো লাগছে। পুরোনো ভবন, কারুকাজ, জমিদারি একটা ছোঁয়া আছে সবকিছুতে। তবে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিয়ে এটাকে আরেকটু পরিপাটি করলে আরও ভালো লাগবে।

প্রিতম রায় নামের আরেক দর্শনার্থী বলেন, এত সুন্দর একটা জমিদারবাড়ি, তা না দেখলে বোঝা যাবে না। কিন্তু বেশ অগোছাল। স্থানীয় প্রশাসন যদি উদ্যোগ নেয় এ বাড়িটিকে আরও নান্দনিক করতে পারে। প্রয়োজনে টিকিটের বিনিময়ও হতে পারে। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। আমরা চাই এই বাড়িটি টিকে থাকুক, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে এটি দেখতে পারে।

পাইকারচর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আবুল হাসেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা চাই এটা সংস্কার হোক। কিছুদিন পরপরই উপজেলা প্রশাসন থেকে লোক আসে। আবার খোঁজ থাকে না। এবার আশা রাখি কিছু একটা হবে। এটা ভালোভাবে সংস্কার করা গেলে এখানে নরসিংদীর বাইরের দর্শনার্থীরা অনায়াসে আসবে।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদি মোর্শেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা একটা বিস্তৃত পরিসর। বেশ পুরোনো বাড়ি। তাই চাইলেই এটার বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। তবে বিষয়টি নিয়ে আমি আমার ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয় দেখব।

যেভাবে যাবেন জমিদারবাড়িতে
ঢাকার গুলিস্তান, সায়দাবাদ, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে করে মাধবদী বাসস্ট্যান্ড (বাসভেদে ভাড়া ৭০ থেকে ১০০ টাকা)। সেখান থেকে রিকশা করে মাধবদী সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড, ভাড়া নেবে ১০ টাকা। তারপর সিএনজিচালিত অটোতে করে জমিদারবাড়ি যেতে লাগবে ৩০ টাকা।

অন্যদিকে, ট্রেনে এসে নামতে হবে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে। সেখান থেকে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড যে ৫ টাকা অটোতে করে। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোতে করে মাধবদী সিএনজিচালিত অটোস্ট্যান্ড পর্যন্ত ৩০ টাকা। পরে আবার মাধবদী সিএনজিচালিত অটোস্ট্যান্ড থেকে বালাপুর জমিদার বাড়িতে পৌঁছাবেন ৩০ টাকার বিনিময়ে।

এনএ