অনিমা চৌধুরী ওরফে মিনা ঘোষ

অনিমা চৌধুরী ওরফে মিনা ঘোষের বাড়ি ছিল কলকাতায়। তাদের বাড়ির পাশেই বোনের বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন বীরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ। বোনের পছন্দ অনুযায়ী পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করে অনিমাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন বীরেন্দ্র।

তিনি পেশায় ছিলেন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় এসেছেন অনিমা। বিয়ের দুই বছরের মাথায় সংসার আলোকিত করে জন্ম নেয় একমাত্র ছেলেসন্তান মনোজ কুমার ঘোষ। এরপর জন্ম হয় মেয়ে নিপু ঘোষের।

বেশ ভালোই কাটছিল সংসার। হঠাৎ অজ্ঞাতরোগে আক্রান্ত হয়ে স্বামী বীরেন্দ্র মারা যান। ছেলে মনোজ ডাক বিভাগে চাকরি নেওয়ার পর তাকে বিয়ে করিয়ে ঘরে আনেন পুত্রবধূ। এরপরই জীবনের স্বাভাবিক গল্প পাল্টাতে থাকে অনিমার।

অনিমা জানান, ছেলের জন্মের পর অনেক আদর যত্ন করে তাকে মানুষ করেছি। মাটিতে রাখিনি পিঁপড়ে খাবে, মাথায় রাখিনি কাকে ঠুকরাবে, সবসময় বুকে রেখেছি। ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করলাম, ছেলের চাকরি হলো। ছেলে চাকরিতে আর মেয়ে স্কুলে গেলে ঘরটি শূন্য থাকত, একা একা ভালো লাগত না।

তিনি আরও জানান, পরে ছেলেকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে বিয়েও করালাম। স্বামীর রেখে যাওয়া প্রপার্টি, ছেলের চাকরির বেতনে বেশ সুখেই কাটছিল আমাদের দিন। মেয়েকে বিয়ে দিলাম। হঠাৎ স্ট্রোকে ছেলের মৃত্যুর পর সবই যেন কেমন ওলটপালট হয়ে গেল।

তিনি বলেন, ছেলের মৃত্যুর পর আমার সংসারের দায়িত্ব নিল আমার ছেলের স্ত্রী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। কারণে-অকারণে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করত সে। আমাকে অবজ্ঞা আর অবহেলা করতে করতে একসময় বাড়ি থেকে চলে যেতে বলল।

তিনি আরও বলেন, মনোজের একটি ছেলে আছে, সে ‘ঠাকুমা ঠাকুমা’ বলে পাগল ছিল। বাবার (মনোজের) মৃত্যুর পর মায়ের ভয়ে এখন আর কাছে আসে না। গোপনে কাছে আসলেও বউমা তাকে বকা দিত। আমাকে ভোলাতে তাকে জোর করে নানুবাড়ি আর মামার বাড়িতে পাঠানো হতো। আমার কাছে আসতে দিত না।

পরে আমার মেয়ে এসব জানতে পেরে আমাকে তার সংসারে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সেখানে সমস্যা থাকায় আমাকে আপাতত এখানে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছে। বলেছে, কিছুদিন পর এসে নিয়ে যাবে। গাজীপুরের সদর উপজেলার বিশিয়া কুড়িবাড়ী এলাকায় বয়স্ক পুনবার্সন কেন্দ্রে নাতির স্মৃতি আঁকড়ে ধরে স্বজনদের কাছে ফেরার অপেক্ষায় দিন কাটছে তার।

কাঁদতে কাঁদতে এই প্রবীণ নারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি রাজরানি ছিলাম, এখানেও রাজরানি আছি। এখানে কোনো কিছুর অভাব নেই, এখানে স্বাধীনতা আছে। ডাক্তার খরচ, জামা-কাপড়, খাওয়া খরচ সবই দেয়। শুধু আমার মনটা পড়ে থাকে নাতির কাছে। আমার মনোজ বেঁচে থাকলে কি আমার এ অবস্থা হতো?

গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া মনিপুর এলাকায় গিভেন্সী গ্রুপের কর্ণধার খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসহায় প্রবীণদের জীবনের শেষ ঠিকানা ‌বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ৮০ জন পুরুষ এবং ৭০ জন নারী রয়েছেন। 

শিহাব খান/এমএসআর/জেএস