রাত-দিন চলছে মিল। দম ফেলার ফুসরত নেই শ্রমিকদের। উৎপাদিত হচ্ছে টন টন নারিকেল তেল। চলে যাচ্ছে দেশের সর্বত্র। কর্মসংস্থান হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। শক্তিশালী হচ্ছে দেশের অর্থনীতির চাকা। দুই দশক আগেও এমন চিত্র দেখা গেছে বাগেরহাটের নারিকেল তেলের কারখানায়। অনেক দূর থেকে শোনা যেত কারখানার শব্দ। তেলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করত আশপাশের এলাকা। তবে সেই শব্দ আর ঘ্রাণ এখন শুধু মিল এলাকায় সীমাবদ্ধ।

পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, কাঁচামাল সঙ্কট, বাজারে মোড়কজাত তেলের আধিপত্য, অনেক জেলায় নারিকেল তেলের মিল গড়ে ওঠাসহ নানা কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রাংশ। কর্মহীন হয়ে পড়েছে মিলের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা। ২০ বছরের ব্যবধানে উৎপাদন কমেছে প্রায় ৯০ ভাগ।


 
বিসিক ও মিল মালিক সূত্রে জানা গেছে,  দুই দশক আগেও বাগেরহাটে ৬০টির বেশি মিলে উৎপাদিত হত নারিকেলের তেল। নারিকেল প্রক্রিয়াজাতের সঙ্গে জড়িত ছিল দুই হাজারের বেশি নারী ও পুরুষ শ্রমিক। প্রতিদিন উৎপাদিত হত প্রায় ২৫-৩০ মেট্রিক টন তেল। জেলার চাহিদা মিটিয়ে এই তেল চলে যেত ঢাকা, রাজশাহী, বগুড়া, রাজবাড়ী, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায়। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে বন্ধ হতে থাকে মিলগুলো। বর্তমানে জেলায় চালু আছে মাত্র ১০টি মিল। এর মধ্যে শুধু বিসিক শিল্প নগরীতে ছয়টি ও যাত্রাপুর, চুলকাঠী, সিঅ্যান্ডবি বাজারে চারটি মিল চালু রয়েছে।

সরেজমিনে বাগেরহাট বিসিক শিল্প নগরীতে দেখা যায়, চারিদিকে নীরবতা। হাতেগোনা কয়েকটি মিল চালু রয়েছে। দুই-চারজন শ্রমিক কাজ করছেন সেখানে। কোনো মিলের চাকা ঘুরছে আবার কোনোটি বন্ধ রয়েছে। একদিকে চাহিদা অনুযায়ী নারিকেলের অভাব, অন্যদিকে মোকামে পাইকারদের কাছে বকেয়া। মহামারি করোনার থাবা তো রয়েছেই। সব মিলে মিল বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী। যারা এখনও টিকে রয়েছেন একরাশ হতাশার ছায়া তাদের চোখেমুখে। 

শিল্প নগরীতে অবস্থিত কোকোনাট ওয়েল মিল সাহা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জীবন কৃষ্ণ সাহা বলেন, ১৯৯৮ সালে মিলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে দৈনিক ৫০০ কেজি তেল উৎপাদন হত। চাহিদা থাকায় এক পর্যায়ে উৎপাদন বেড়ে ৮০০-৯০০ কেজিতে দাঁড়ায়। জেলায় দৈনিক নারিকেল তেল উৎপাদন হতো ২৪-২৫ টন। তখন এই ব্যবসায় জড়িত ছিলেন অনেক ব্যবসায়ী। 

কিন্তু ২০০৬ সালের দিকে বাজারে মোড়কজাত তেল প্যারাসুট বিক্রি শুরু হলে কমতে থাকে এই তেলের চাহিদা। পাশাপাশি নারিকেলের উৎপাদন কমে যায়। বর্তমানে আমার মিলে দৈনিক ২০০ কেজির বেশি তেল উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। মিল চালুর প্রথম দিকে প্রতি কেজি তেল দেড়শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো। পরে ছয়শ থেকে সাতশ টাকা দরেও বিক্রি করেছি। আর এখন সেই তেল বিক্রি করতে হচ্ছে চারশ টাকায়।

অপর এক ব্যবসায়ী অশোক সাহা বলেন, বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে নারিকেল তেলের জন্য বাগেরহাট ছিল বিখ্যাত। দিন দিন তেলের উৎপাদন কমতে থাকায় এখন আর সেই জৌলুস নেই। নারিকেলের উৎপাদন বাড়লেও হাটে পর্যাপ্ত নারিকেল ওঠে না। উৎপাদিত নারিকেল বেশিরভাগই ডাব হিসেবে চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহরে। যার ফলে শুকনা নারিকেলের অভাব দেখা দিয়েছে হাটগুলোতে। ৫-৭ বছর আগেও মিলে চারটি কড়াইতে রাত দিন ২৪ ঘণ্টা তেল ফোটানো হতো। আর এখন একটি কড়াইও ঠিকমতো চলে না। খুব দুর্দিনে আছি বলে হতাশা প্রকাশ করেন এই ব্যবসায়ী।

বন্ধ হয়ে যাওয়া স্বর্ণালী অটো কোকোনাট অয়েল মিলের স্বত্বাধিকারী শংকর সাহা বলেন, অনেক কষ্ট নিয়ে মিল বন্ধ করেছি। চাহিদা অনুযায়ী নারিকেলের অভাব, মোকামে পাইকারদের কাছে বকেয়া, করোনাকালীন সংকট, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি সব কিছু মিলে বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

রামপালের চাকশ্রী এলাকার নারিকেল ব্যবসায়ী শেখ ইউসুফ আলী বলেন, এক যুগ আগেও বিভিন্ন হাট থেকে পাঁচ-ছয় হাজার পিস নারিকেল কিনতাম। বর্তমানে হাটে নারিকেল না পাওয়ায় এক হাজারের বেশি নারিকেল কেনা সম্ভব হয় না। আগের মতো ব্যবসা না হওয়ায় এখন সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়।
 
সদর উপজেলার ডেমা এলাকার বাসিন্দা শোভন তরফদার জানান, পারিবারিকভাবে আমাদের প্রায় শতাধিক নারিকেল গাছ রয়েছে। আগে বাপ-দাদারা শুকনা নারিকেল হাটে নিয়ে বিক্রি করত। কিন্তু এখন ডাব ক্রেতারা বাড়িতে এসে ডাব কিনে নিয়ে যায়। কষ্টও হয় না, দামও ভালো পাওয়া যায়।

তেল মিলের শ্রমিক হেলেনা বেগম বলেন, আট বছর আগে নারিকেল ভেঙে প্রতি মাসে তিন-চার হাজার টাকা করে আয় করতাম। বর্তমানে এক হাজার টাকার বেশি আয় করতে পারি না। অন্য কোনো কাজ না থাকায় বাধ্য হয়ে এই মিলে কাজ করছি। এর আগে অন্য দুটি মিলে কাজ করেছি। সেই মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

পেশা বদলে ফেলা একাধিক শ্রমিক জানান, পাঁচ বছর আগে এ কাজে যে মজুরি পাওয়া যেত, এখনও তাই আছে। ফলে বাঁচার তাগিদে বাধ্য হয়ে তারা পেশা বদল করছেন।
 

বাগেহাট বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সভাপতি শিব প্রসাদ ঘোষ বলেন, দিন দিন বিসিকের মিল-কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত আমরা। এতগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকার পরেও রয়েছে অবকাঠামোগত সমস্যা, নেই ভালো কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা। বৃষ্টি বা জোয়ারে পানি জমে পথে। উন্নয়নের জন্য জেলা প্রশাসকসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরের কাছে বার বার গেছি। কিন্তু কোনো উন্নয়ন হয়নি আমাদের। পৃষ্ঠপোষকতা ও সরকারি সাহায্য না পেলে বিসিকে হাতেগোনা যে কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাও বন্ধ হয়ে যাবে।

জেলা বিসিক কার্যালয়ের উপ-ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শরিফ সরদার বলেন,‘বাগেরহাট বিসিক শিল্প এলাকায় ১৫টি নারিকেল তেলের মিল চালু ছিল। এর মধ্য বর্তমানে ৯টি বন্ধ রয়েছে। বাকি ৬টির উৎপাদনও আগের তুলনায় অনেক কম। মূলত নারিকেলের সংকটের কারণেই মিলগুলো বন্ধ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় নারিকেল তেলের মিল গড়ে ওঠায় জেলার তেলের চাহিদা কমে গেছে।

উল্লেখ্য, শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) পক্ষ থেকে ১৯৯৬ সালে শহরের ভৈরব নদের পাশে প্রায় ২১ একর জমির ওপর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নগরী গড়ে তোলা হয়। এই শিল্প নগরীতে ১২৩টি প্লট রয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য রয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ উপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রতিটি প্লটই বরাদ্দ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বছর দশেক আগেও এখানে ৫৭টি শিল্প কারখানা চালু ছিল। কিন্তু ভঙ্গুর অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার অভাবে বর্তমানে মাত্র ৩৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ইজিবাইক সেটিংস, নারিকেল তেল, অটো রাইস ও ফ্লোয়ার, সরিষা, ডাল মিল, পুরোনো প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাতকরণ, কোকোনাট ফাইবার মিলস অন্যতম।

তানজীম আহমেদ/এসপি