দেশে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার উপযোগী মাছের ভ্যাকসিন ‘বায়োফ্লিম’ উদ্ভাবন করেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। বাণিজ্যিকভাবে সাফল্যের সম্ভাবনা থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে আলোর মুখ দেখেনি এ ভ্যাকসিনটি। তবে এবার ল্যাব থেকে মাঠ পর্যায়ে ‘বায়োফ্লিম’ ভ্যাকসিনের গবেষণা শুরু হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ল্যাবে বেশ কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযুক্ত হয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বৃহস্পতিবার (৭ অক্টোবর) দুপুর সাড়ে ১২টায় ল্যাবে ফিতা কেটে নতুন যন্ত্রপাতির উদ্বোধন করেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. মো. মতিয়ার রহমান। পরবর্তীতে সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন সবাইকে প্রতিটি যন্ত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।

‘বায়োফ্লিম’ ভ্যাকসিনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মড়ক প্রায় ৮৪ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে আরও গবেষণার মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব।  

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ সূত্রে জানা যায়, গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবিত ‘বায়োফ্লিম’ নামের ভ্যাকসিনটি স্বাদু পানিতে চাষকৃত মাছের এরোমোনাস হাইড্রোফিলা নামক ব্যাকটেরিয়া জনিত ক্ষত যা আলসার, পাখনা ও লেজ পচা রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। শুরুতে পাঙ্গাস মাছের উপর এই ভ্যাকসিনটি প্রয়োগ করলে ৮৪ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে অন্যান্য মাছে প্রয়োগেও এর সফলতা পাওয়া যায়।

গবেষণা কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে সম্প্রতি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় মৎস্য বিজ্ঞান অনুষদকে। বরাদ্দকৃত সে অর্থ দিয়ে কেনা হয় বায়োফ্লিম ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ করার জন্য ছয়টি আধুনিক যন্ত্র। এদের মধ্যে রেফ্রিজারেটেড শেকার ইনকিউবেটর, অটোক্লেভ মেশিন, লেমিনার এয়ারফ্লো, বায়োকেমেস্ট্রি এনালাইজার, হট এয়ার ওয়েভার ও কম্পিউটার মাইক্রোস্কোপ।

বায়োফ্লিম ভ্যাকসিনের উদ্ভাবক ড. মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, নতুন এ যন্ত্রপাতি গবেষণা কার্যক্রমকে আরও বেশি ত্বরান্নিত করবে। আগে শুধু ল্যাব পর্যায়ে এটি নিয়ে গবেষণা করা যেত। গবেষণা কার্যক্রমকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যন্ত্রপাতির সংকট ছিল। সেটি এখন কেটে গেছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা মাঠ পর্যায়ে এ ভ্যাকসিন নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারব। পাঙ্গাস মাছের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনটি শতকরা ৮৪ ভাগ কার্যকর বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। ভ্যাকসিনটি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ শেষ করে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব। তবে মাঠ পর্যায়ে ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ শেষ করার পরেই এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত বলা সম্ভব হবে। আমরা এখন বিভিন্ন পুকুরে এই এটি নিয়ে কাজ করব। এজন্য ইতোমধ্যে পুকুরও নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশে প্রথম এই ভ্যাকসিনটি পাঁচ মিলিমিটার উৎপাদন করেছি।

জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, চিলিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৮ প্রজাতির মাছে ২৮ ধরনের ভ্যাকসিন বানিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহার হলেও বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এ ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হয়েছে। পাঙ্গাস মাছের উপর গবেষণা করে ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবন করা হলেও তা স্বাদুপানিতে চাষযোগ্য ইন্ডিয়ান মেজর কার্প যেমন রুই, কাতলা, কই, শিং প্রভৃতি মাছের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. মতিয়ার রহমান হাওলাদার বলেন, ভ্যাকসিনটি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন অনুসারে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের একটি প্রোপোজাল দেওয়া হয়। সে ভিত্তিতে ২৫ লাখ টাকাও বরাদ্দ দেওয়া হয়। দেশের মৎস্য খাতকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এমনকি শিক্ষার্থীরা গবেষণার সুযোগ পাবে এখানে। ভ্যাকসিন নিয়ে কাজের ক্ষেত্রটি একটি ছোট প্রয়াস মাত্র। যারাই এগিয়ে এসেছেন এই প্রয়াস বাস্তবায়নে সকলকে ধন্যবাদ জানাই।  

বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন হয় প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বের ৫৫টি দেশে রপ্তানি করা হয়। তবে মাছের বিভিন্ন রোগের কারণে মড়ক দেখা দেয়। এতে প্রচুর পরিমাণ মাছ মারা যায়। মাছ চাষিরা আথির্কভাবে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্থ হন। আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম হলেও কার্যকরী ভ্যাকসিনের অভাবে প্রতিবছর বিভিন্ন রোগে প্রচুর পরিমাণ মাছে মড়ক ধরে। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন মৎস্য চাষিরা অন্যদিকে কমছে মাছের উৎপাদন। ভ্যাকসিনটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা গেলে লাভবান হবেন দেশের মৎস্য চাষিরা।

তুহিন আহমদ/আরআই