এখনও অবুঝ অপূর্ব মিয়া ও জ্যোতি আক্তার। অপূর্বর বয়স সাত বছর। আর জ্যোতির পাঁচ। তাদের চোখের সামনে প্রিয় মা-বাবার মৃতদেহ বসতঘর থেকে বের করে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। অথচ মা-বাবার মৃত্যুর বিষয়ে বোধগম্য নয় তারা। তাই তারা শোকে স্তব্ধ বাড়ি ভর্তি মানুষের মাঝেও দিব্যি ছুটাছুটি করছে। খেলনা নিয়ে করছে খেলাধুলা।

তারা নেত্রকোনার মদন উপজেলার তিয়শ্রী ইউনিয়নের বালালী নান্দু মীর ও হিমা আক্তার দম্পতির সন্তান।

মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) ভোর ৬টার দিকে স্থানীয়রা বসতঘরের মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় হিমা আক্তারের (৪৫) মৃতদেহ এবং একই ঘরের আঁড়ার সঙ্গে নান্দু মীরের (৫৫) ঝুলন্ত মৃতদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ সকাল পৌনে ১১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে মৃতদেহ দুটি উদ্ধার করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে ময়নাদতন্তের জন্য দুপুরে তা নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়।

স্থানীয় তিয়শ্রী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ফখরুদ্দিন জানান, মা-বাবা হারানো অবুঝ ও অসহায় শিশু দুটি বর্তমানে তাদের মামা আব্দুল্লাহ আল মামুনের আশ্রয়ে রয়েছে। শিশুদের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হচ্ছে তাদের মা-বাবা। কিন্তু বোঝার বয়স হওয়ার আগেই শিশু দুটি আশ্রয়হীন হয়ে গেল। এটা খুব মর্মান্তিক। তিনি বলেন, আমি আমার চেষ্টা অনুযায়ী এই শিশুই সহায়তা করব ইনশাল্লাহ।  

শিশু দুটির মামা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, অবুঝ শিশু দুটি প্রথমে ঘরের দরজা খুলে দেয়। এ সময় তার মা-বাবা কোথায় জিজ্ঞেস করলে তারা লোকজনকে জানায়, তাদের মা শুয়ে আছে এবং বাবা দাঁড়িয়ে আছে। অথচ দুজনই তখন মৃত। ঘটনার সংবাদ পেয়ে পুলিশসহ এলাকার লোকজন এসে বাড়িতে ভিড় জমায়। সমস্ত এলাকা শোকে স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অপূর্ব ও জ্যোতি বুঝেইনি যে তাদের মা-বাবা মারা গেছে। কারণ তখনও তারা বাড়িজুড়ে ছুটাছুটি করছিল এবং আমার ঘরে বসে খেলাধুলা করছিল। 

অপূর্ব স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্টেনে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং জ্যোতি একই স্কুলে প্লে শ্রেণিতে পড়ে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, অসহায় ও অবুঝ এই দুই শিশুকে লালন পালনের দায়িত্ব এখন থেকে আমিই পালন করব। 

পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন আগে উপজেলার নায়েকপুর ইউনিয়নের আলমশ্রী গ্রামের মৃত শামছু মীরের ছেলে নান্দু মীরের সঙ্গে একই উপজেলার তিয়শ্রী ইউনিয়নের বালালী গ্রামের আব্দুল মন্নাফের মেয়ে হিমা আক্তারের বিয়ে হয়। বিয়ের পর নান্দু মীর নিজ গ্রাম ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি বালালী গ্রামে বসতবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করে আসছিলেন। এরই মধ্যে জন্ম নেয় শিশু অপূর্ব ও জ্যোতি। তবে বিয়ের পর থেকে প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ লেগে থাকত বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে ঘটনার দিন সোমবার (১১ অক্টোবর) দিনগত রাতের খাওয়া শেষে প্রতিদিনের মতো সন্তানদের নিয়ে একই বসতঘরে ঘুমিয়ে পড়েন নান্দু মীর ও হিমা আক্তার। পরে ভোর ৬টার দিকে একই গ্রামের সোনাই মিয়া নামে এক ব্যক্তি নান্দু মীরকে খুঁজে তার বাড়িতে গেলে তিনি ঘরের দরজা বন্ধ দেখতে পান।

এ সময় তিনি নান্দু মীরকে ডাকাডাকি শুরু করলে দরজা না খোলায় একপর্যায়ে নান্দু মীরের শিশুসন্তানরা ঘরের দরজা খুলে দিলে ওই ব্যক্তি ঘরের মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় হিমা আক্তারের মৃতদেহ এবং ঘরের আঁড়ার সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় নান্দু মীরের মৃতদেহ দেখতে পান। পরে তিনি চিৎকার শুরু করলে প্রতিবেশীরা ছুটে যান এবং পুলিশকে খবর দেন।

মদন থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, সংবাদ পেয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আকবর আলী মুন্সী মহোদয় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং ঘটনার তদন্তে পিবিআই ও সিআইডির ক্রাইমসিন টিম ঘটনাস্থল কটন করে রেখে আলামত সংগ্রহ করেছে। 

নেত্রকোনার পুলিশ সুপার মো. আকবর আলী মুন্সী জানান, ঘটনাটির সঠিক কোনো ক্লু এখনো পাওয়া যায়নি। তবে স্ত্রীকে শাবল দিয়ে আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে স্বামী নিজেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে ধরাণা করা হচ্ছে।

জিয়াউর রহমান/এমএএস