গ্রাহকের ৩ কোটি টাকা নিয়ে এনজিও উধাও, দুই কর্মী অবরুদ্ধ
চাঁপাইনবাবগঞ্জে যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থা নামে একটি এনজিও গ্রাহকের প্রায় তিন কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় গ্রাহকরা সংস্থাটির দুই কর্মীকে গত আটদিন ধরে একটি অফিস কক্ষে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। গত ১১ অক্টোবর টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় ছয় শতাধিক গ্রাহক চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চককীর্তি ইউনিয়নের চাতরা নতুন বাজার মোড়ে যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থার শাখা অফিসে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। ওই সময় সংস্থাটির দুই কর্মীকে অবরুদ্ধ করে রাখেন তারা।
গ্রাহক, এনজিও কর্মী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থার চাতরা শাখায় প্রায় এক হাজার গ্রাহকের ২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা বিভিন্ন মেয়াদে জমা রয়েছে। এর বিপরীতে এই শাখায় ঋণ ছাড়া আছে ১৭ লাখ টাকা। গ্রাহকরা তাদের জমাকৃত টাকা ফেরত চাইলে নানা তালবাহানা শুরু করেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঈন আলী।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাইক্রো ক্রেডিট অথোরিটির (এমআরএ) নিবন্ধন না থাকলেও স্থানীয়ভাবে সমাজসেবা, মহিলা সংস্থা ও যুব উন্নয়ন থেকে অনুমোদন প্রাপ্ত হয়ে ১৬টি শাখার মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করছিল যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থা। গত ছয় মাসে ধাইনগর, চৌডালাসহ চারটি শাখা বন্ধ হয়ে গেলে চাতরা নতুন বাজারের শাখায় ভিড় করতে থাকেন গ্রাহকরা। গত ১০ অক্টোবর রাতে কয়েকজন গ্রাহক চাতরা শাখাটিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জানতে পেরে সংস্থাটির এরিয়া ম্যানেজার কবির হোসেন ও চাতরা শাখা ব্যবস্থাপক সেলিম রেজাকে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখেন।
সোমবার (১৮ অক্টোবর) যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থার চাতরা শাখায় গিয়ে দেখা যায়, দুই কর্মী কবির হোসেন ও সেলিম রেজা এখনও অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন। তাদের স্বজনরা এসে দেখা করে যাচ্ছেন। বাড়ি থেকে স্বজনরা খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে মুঠোফোন নিয়ে নেয়া হয়েছে। গত আট দিন ধরে এই অফিসের মধ্যেই থাকছেন তারা। তাদের পাহারা দিচ্ছেন গ্রাহকদের লোকজন।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, ঘটনার পর জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেও স্থানীয় জনতা আটক দুই কর্মীকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে দেয়নি। পরে পুলিশ স্থানীয় ব্যবসায়ী ও গ্রাহক মানু মিয়াকে তাদের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে চলে যায়।
যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থায় ২০ লাখ টাকা জমা রেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন মানু মিয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংস্থাটি দীর্ঘদিন ধরে টাকা দিতে অস্বীকার করে আসছে। দিব, দিচ্ছি করে সময় পার করছে। কয়েকদিন আগে তাদের আরও কয়েকটি শাখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে গ্রাহকরা দুই কর্মীকে শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের ত্রিমোহনী বাজার থেকে আটক করে চাতরা শাখায় নিয়ে আসে। তারপর থেকে তাদেরকে এখানেই আটক করে রাখা হয়েছে।
আরেক গ্রাহক আব্দুর রাকিব জানান, গত সোমবার (১১ অক্টোবর) গ্রাহকদের বিক্ষোভের ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঈন আলী পলাতক রয়েছে। তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্ষুব্ধ গ্রাহকদের অবস্থা এমন যে, তাকে পেলে মেরে ফেলবে। কারণ অনেক অসহায় মানুষ তাদের জমানো সব টাকা সেখানে কিছু লাভের আশায় জমা রেখেছিল।
স্থানীয় বাসিন্দা হাসেম মিঞা জানান, তার ভগ্নিপতি মারা যাওয়ার পর বোন হাজেরা বেগম সংসারের খরচ চালাতে এবং নিজের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে জমি বিক্রির আট লাখ টাকা যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থার চাতরা শাখায় রেখে লাভের টাকায় সংসার চালাতেন। কিন্তু গত ছয় মাস ধরে তিনি লাভ তো দূরের কথা মূল টাকাও পাচ্ছেন না। উল্টো তাদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।
অবরুদ্ধ দুই এনজিও কর্মীর দেখভালের দায়িত্বে থাকা এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত আট দিনের মধ্যে দুইবার লোকজন এসেছিল তাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে। কিন্তু আমরা সবসময় সতর্ক থাকায় তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত টাকা না পাব, ততদিন তাদেরকে ছাড়া হবে না। আমরা এখন মালিককে খুঁজছি।
এ বিষয়ে অবরুদ্ধ এরিয়া ম্যানেজার কবির আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এর আগেও ৭-৮ মাস আগে এনজিও মালিক মঈন আলীকে গ্রাহকরা আটক করেছিল। পরে মালিক ১৮ মাসের সময় নিয়েছিলেন গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে। কিন্তু সেই সময়ের প্রথম কিস্তি পরিশোধ না করায় এবং কয়েকটি শাখা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রাহকরা আমাদের দুইজনকে আটক করে রেখেছে।
অবরুদ্ধ আরেক কর্মী সেলিম রেজা বলেন, আমাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নিয়েছে। তাই মালিক বা সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। কী হচ্ছে আর কী হবে কিছুই জানি না। কারণ মালিকের কোনো হদিস মিলছে না। গত আট দিন ধরে এই এক ঘরেই বন্দী অবস্থায় আছি।
এ বিষয়ে কথা বলতে যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মঈন আলীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফরিদ হোসেন জানান, ঘটনার দিন ১১ অক্টোবর পুলিশ জানতে পারে গ্রাহকরা টাকা পাবে, তাই দুই কর্মীকে আটকে রেখেছে। সোমবার (১৮ অক্টোবর) বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ বিষয়ে থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব-আল-রাব্বী ঢাকা পোস্টকে বলেন, যমুনা মানব কল্যাণ সংস্থা নামে কোনো নিবন্ধিত এনজিও নেই। তাই তারা গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেলে আমাদের করণীয় তেমন কিছু নেই। এসব ভুয়া ও অনিবন্ধিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন না করতে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মাইকিং করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলম/আরএআর