দেশের সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারু সাবা ও সারা। তাদের নিয়ে সুইমিং পুলে প্রশিক্ষণে ব্যস্ত বাবা মোহাম্মদ দস্তগীর আব্দুল্লাহ। তার আশা মেয়েরা একদিন সেরাদের সেরা হয়ে উঠবে। এ জন্যই তিনি প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সুর মেয়েদের কণ্ঠেও। সাঁতারে স্বর্ণ জয় করতে চায় দুজনই।

পাচঁ বছরের আয়েশা তাবাসসুম সাবা ২০০ মিটার সাঁতার অনুশীলন করে প্রায় প্রতিদিনই। এই বয়সেই ফ্রি স্টাইল, ব্যাক স্ট্রেক ও ব্রেস্ট স্ট্রোক সাঁতারে সমান পারদর্শী সে। আর তিন বছরের সাইবা জাফরিন সারা কেবল ফ্রি স্টাইল সাঁতার পারে। এখন তারা দেশের সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারু। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু ৩৪তম জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় এই খেতাব পেয়েছে তারা।

রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সুইমিং পুলে দুই মেয়েকে নিয়ে দিনে প্রায় ঘণ্টাখানেক অনুশীলন করেন দস্তগীর আব্দুল্লাহ। সেখানে গিয়ে পাওয়া গেল সাবা, সারা ও তাদের বাবা দস্তগীর আব্দুল্লাহকে। অনুশীলনের ফাকে কথা হয় তাদের সঙ্গে। এখনো আধো বুলি সারার মুখে। বিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি তার।

সবেমাত্র বিদ্যালয়ে যাচ্ছিল সাবা। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে পড়ায় ছেদ পড়ে তাতে। এই সময়টা মার্শাল আর্ট ও সাঁতার প্রশিক্ষণে কাজে লাগিয়েছে সাবা।

সাবা জানায়, সবসময় তার সাঁতার কাটতে মন চায়। বড় হয়ে সে সাঁতার প্রতিযোগিতায় সেরা হতে চায়। একই ভাষ্য আরেক ক্ষুদে সাঁতারু সারারও। তারও ভালো লাগে সাঁতার কাটতে। বড় হয়ে স্বর্ণ জিততে চায় সে।

তাদের বাবা আব্দুল্লাহ দস্তগীর নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা। এলাকায় বেঙ্গল মার্শাল আর্ট একাডেমি নামে একটি মার্শাল আর্ট একাডেমি রয়েছে তার। সেটির পরিচালক ও প্রশিক্ষকেরও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

সাবা ও সারার মা মারুফা খাতুন একই প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষক। উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য এখন ভারতের পাঞ্জাবে রয়েছে মারুফা। ফলে মেয়েদের দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব তাদের বাবার কাঁধে।

সন্তানদের চোখে নিজের স্বপ্ন দেখেন দস্তগীর আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, তারা স্বামী ও স্ত্রী জুডো ও ক্যারাতে খেলোয়ার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু পদকও পেয়েছেন তারা। নিজেরা যেটা পারেননি বাচ্চারা সেটা অর্জন করবে। এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ ও অলিম্পিকের মতো বড় আসরে দেশের হয়ে পদক অর্জন করুক বাচ্চারা- এমন প্রত্যাশা এই বাবার।

বাচ্চাদের ক্ষুদে সাঁতারু হয়ে ওঠার গল্প শুনিয়েছেন আব্দুল্লাহ দস্তগীর। তিনি বলেন, তারা মূলত মার্শাল আর্টিস্ট। বাবা-মায়ের কাছেই প্রশিক্ষণ পেয়েছে তারা। এরই মধ্যে সাবা অর্জন করেছে ব্ল্যাক বেল্ট। আর সারা পেয়েছে অরেঞ্জ বেল্ট। কিন্তু এখন তারা ছোটো। সাঁতার প্রতিযোগিতায় নামার মতো তাদের ওয়েটও নেই। ১৪-১৫ বছর বয়স হওয়ার পর তারা মার্শাল আর্টে নিজেদের প্রতিভার প্রমাণ দেবে। সেই প্রস্তুতিও চলছে। পাশাপাশি তাদের জিমন্যাস্টিক ও সাঁতারে দক্ষ করে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু রাজশাহীতে জিমন্যাস্টিক শেখানোর সুযোগ কম। ফলে সাঁতারেই নামাতে হয়েছে। এরই মধ্যে দেশে সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারুর খেতাব অর্জন করেছে তারা। বাবা হিসেবে মেয়েদের এই অর্জনে আমি গর্বিত।

তিনি জানান, কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন ভোর ৪টার দিকে ঘুম থেমে ওঠে তারা। সাবা প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার দৌড়ায়। আর সারা দৌড়ায় ৫ কিলোমিটার মতো। এরপর আছে সাঁতার অনুশীলন। মার্শাল আর্ট অনুশীলন তো আছেই।

তাদের খাবারেও বিশেষ যত্ন নিতে হয় জানিয়ে বাবা আব্দুল্লাহ দস্তগীর বলেন, প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুধ, ডিম, খেজুর, বাদাম, কলা এসব খায় তারা। সকালে রুটি বা ভাত খাবার অভ্যাসটা নেই। বেলা ২টার দিকে তারা মার্শাল আর্ট অনুশীলনে যায়। এ জন্য দুপুরের খাবারটা সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে সেরে নেয়। রাতের খাবার খায় সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে। রাত ৯টার মধ্যেই তারা ঘুমাতে যায়।

মেয়েদের অনেক দূর নিয়ে যেতে যান আব্দুল্লাহ দস্তগীর। তিনি বলেন, দেশে বিশ্বমানের সাঁতার শেখানোর সুযোগ সীমিত। যে সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা দিয়েই তারা শুরু করেছে। ভারত কিংবা থাইল্যান্ডে তাদের প্রশিক্ষণে নেওয়া হলে ভালো হতো। তাছাড়া জুডো প্রশিক্ষণের জন্য তাদের জাপানেও পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে তিনি নিজ উদ্যোগে মেয়েদের দেশের বাইরে প্রশিক্ষণে নেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন বলেও জানান। 

বাবা ছাড়াও সাবা ও সারাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন কৃতী সাঁতারু এবং জেলা ক্রীড়া সংস্থার সুইমিং ইনস্ট্রাক্টর আব্দুর রউফ রিপন। রিপন জানান, সাবা ২০০ মিটার পাড়ি দেয় অনায়েসেই। ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল ও ব্যাক স্ট্রোক এবং ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্টে নামানো হয়েছিল তাকে।আর সারা নাম লেখায় ৫০ ও ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ইভেন্টে। ৮ থেকে ১০ বছর বয়সী বালিকা গ্রুপে অংশ নিয়ে ৬০০ জন সাঁতারুর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারুর খেতাব জিতে নেয় দুই বোন।

প্রশিক্ষক আরও জানান, জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদকসহ ১১টি পদক পেয়েছে রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থা। তার ইচ্ছা ছিল সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারুর খেতাবটাও নিজেদের দখলে নিতে চান। কিন্তু ছোটো বাচ্চাদের সাঁতারে দিতে রাজি হন না অভিভাবকরা। শেষে নিজের চার বছর বয়সী শিশু সন্তান তামিম মাহদিকে সুইমিং পুলে নামান। ওই সময় ফেসবুকে একটি বার্তাও দেন। তা দেখে সাবা ও সারাকে প্রশিক্ষণে নিয়ে আসেন তাদের বাবা। পরে চারজন বাচ্চা নিয়ে তিনি প্রশিক্ষণ শুরু করেন। প্রশিক্ষণ শুরুর সপ্তাহ না যেতেই বাচ্চাদের ঠাণ্ডা লেগে যায়। এতে বাকিরা অনিয়মিত হয়ে পড়লেও সাবা ও সারা ছিল নিয়মিত। সাবা পুরোপুরি সাঁতার শিখেছে ২২টি ক্লাসে। প্রথম দিকে সে ভয় করত। কিন্তু পরে তার ভয় কেটে যায়।

সারার চেয়ে সাবাকে নিয়ে বেশি আশাবাদী প্রশিক্ষক রিপন। তিনি বলেন, সারা এখনো অনেক ছোট। আর পাঁচ বছর বয়সী সাবা। সে অনায়েসে ব্যাক স্ট্রোক সাঁতার কাটছে। বয়সভিত্তিক সাঁতারে নিজের সেরাটা দিতে এখনো পাঁচ বছর সময় পাচ্ছে সে। এই সময়ের ভেতরে তাকে দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব। আগামী ২০২৩ সালে বয়সভিত্তিক সাঁতারে সাবার হাত ধরে স্বর্ণপদক জয়ের প্রত্যাশাও করেন তিনি।

রাজশাহীতে সাঁতার প্রশিক্ষণের হালচাল চানতে চাইলে এই প্রশিক্ষক বলেন, কেবল রাজশাহী নয়, দেশেই বিশ্বমানের সাঁতার প্রশিক্ষণের সুযোগ সীমিত। স্থানীয় পর্যায়ের প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণার্থীদের একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। বিকেএসপির মতো আরও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান থাকলে ভালো খেলোয়াড় পাওয়া যেত।

দেশে সাঁতারের ভবিষ্যৎ নিয়ে জানতে চাইলে প্রশিক্ষক রিপন বলেন, দেশের ক্রিকেট একটা পর্যায়ে চলে গেছে। ফুটবলও তাই। কিন্তু অন্যান্য একক ইভেন্টগুলো তাদের ধারে-কাছেও পৌঁছাতেই পারেনি। ফলে নিজেদের ভবিষ্যৎ ভেবে খেলোয়াড়রা একটা পর্যায়ে গিয়ে পিছিয়ে যান। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এমনকি চাকরির বন্দোবস্ত থাকলে আরও বেশি খেলোয়াড় তৈরি হতো।

রাজশাহীর ক্ষুদে দুই সাঁতারুর কৃতিত্বে বেশ উচ্ছ্বসিত রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতির দায়িত্বেও রয়েছেন জেলা প্রশাসক। তিনি বলেন, দেশের সর্বকনিষ্ঠ সাঁতারু সাবা ও সারা রাজশাহীর গর্ব। তাদের আরও ভালো প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার আমরা করবো। আরও যারা ক্ষুদে সাঁতারু আছে তাদের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে প্রতিযোগিতায় নাম লেখানোর আহ্বান জানান জেলা প্রশাসক।

রাজশাহীর সাঁতার প্রশিক্ষণ পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সুইমিং পুল অকার্যকর হয়ে পড়ে ছিল। সেটি সংস্কার করে আমরা প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আরও উন্নয়নের প্রয়োজন হলে আমরা সেটিও করবো।

আরএআর