সাত বছর ধরে খুঁটিতে বাঁধা শান্ত

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শান্ত হোসেনের বয়স ১০ বছর। দিনমজুর পরিবারে জন্ম হওয়ায় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। ব্যয়বহুল হওয়ায় তার চিকিৎসা করাতে পারছে না পরিবার। জন্মের তিন বছর পর থেকে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে শান্ত। তার আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে সাত বছর ধরে বেঁধে রাখছেন বাবা-মা।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার ছাতিয়ান ইউনিয়নের কালিতলা এলাকার জসিম উদ্দিনের ছেলে শান্ত। তিন ভাইয়ের মধ্যে শান্ত সবার বড়। সাত বছরের মেজো ভাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। পাঁচ বছরের ছোটভাই বাড়িতে থাকে। জন্মের তিন বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল শান্ত। এরপর থেকে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু হয় তার।

শনিবার (২৩ জানুয়ারি) সরেজমিনে জসিম উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের বারান্দায় মাটিতে বসে বাঁ হাতে ভাত খাচ্ছে শান্ত। তার বাঁ পা খুঁটিতে বাঁধা। ভাত খাচ্ছে আর মাঝেমধ্যে ছিটিয়ে ফেলছে। কেমন আছো জানতে চাইলে শান্ত কিছুক্ষণ চুপ থাকে। হঠাৎ বলে, আমার শরীর ভালো না। কথা বলব না। আমাকে ছেড়ে দে; আমি ভাত খাব।

নিজের মলমূত্র, মুরগির আবর্জনা, ড্রেনের কাদা ও গোবরসহ সামনে যা পায় তাই-ই খায় শান্ত। ভালোভাবে হাঁটতে পারে না। প্রতিবেশীর ঘরে ঢিল ছোড়ে, সামনে যাকে পায় তাকে মারধর করে। ঘরের জিনিসপত্র আগুন কিংবা পানিতে ফেলে দেয়। অন্যের ছেলে-মেয়েকে মারধর করে, প্রতিবেশীর ঘরে ঢুকে খাবার চায়, না পেলে ভাঙচুর করে। অস্বাভাবিক এসব আচরণের জন্য সাত বছর ধরে ঘরের খুঁটির সঙ্গে রশি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ওখানে তার খাওয়া-দাওয়া, ওখানেই প্রস্রাব-পায়খানা এবং ঘুম।

সীমা খাতুন, শান্ত হোসেনের মা

সীমা খাতুন বলেন, সাত বছর ধরে ছেলের মানসিক সমস্যা। প্রথমে চিকিৎসা করালেও এখন বন্ধ। ওষুধ কেনার টাকা নেই। দিনরাত এই খুঁটিতে বেঁধে রাখি। খাওয়া-দাওয়া, প্রস্রাব-পায়খানা পরিষ্কার করতে করতে অসহ্য হয়ে গেছি। 

তিনি বলেন, দিন দিন সমস্যা বেড়েই চলছে তার। আমরা খুবই গরিব, কীভাবে ছেলের চিকিৎসা করাব? দুই বছর আগে পাবনার চিকিৎসক বলেছেন, একাধারে পাঁচ বছর চিকিৎসা চালাতে। দুই মাস চালানোর পর টাকার অভাবে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। ঠিকমতো তিন বেলা খাবার জোটে না কীভাবে চিকিৎসা চালাব। তবে ওষুধ চলা অবস্থায় মোটামুটি ভালো থাকে শান্ত, ওষুধ বন্ধ হয়ে গেলে আগের অবস্থায় চলে যায়। ছেলেটাকে নিয়ে আমরা খুব অসহায়। সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চাই। আপনাদের সহযোগিতায় হয়তো বেঁচে যাবে আমার সন্তান।

তার আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে সাত বছর ধরে বেঁধে রাখছেন বাবা-মা

প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জসিম উদ্দিন দিনমজুর। সহায়-সম্পত্তি বলে কিছু নেই। ভাঙাচোরা ঘরে তার পরিবারের বসবাস। ঘরের চাল দিয়ে কুয়াশা পড়ে। বর্ষাকালে অন্যের ঘরে আশ্রয় নেয় পরিবারের সবাই। কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে দরিদ্র পরিবারটির সদস্যরা।

জসিম উদ্দিনের প্রতিবেশী ছমিরুল ইসলাম বলেন, আচরণ দেখে মনে হয় শান্ত পাগল। মলমূত্র-গোবর যা পায় তা-ই খায়। তার বাঁধন খুলে দিলে যাকে সামনে পায় তাকেই মারধর করে। এজন্যই তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না পরিবার। তারা খুবই দরিদ্র।

আরেক প্রতিবেশী নবীউদ্দীন বলেন, এই ছেলে ময়লা-আবর্জনা সবই খায়। অনেক বছর ধরে সমস্যা। পুরোপুরি পাগল। তাকে সবসময় রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। অর্থাভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না তার।

শান্তর বাবা জসিম উদ্দিন বলেন, সাত বছর ধরে আমার ছেলে মানসিক ভারসাম্যহীন। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমি দিনমজুর। দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয়। ধারদেনা করে সংসার চালাতে হয়। ছেলের চিকিৎসা করার সামর্থ্য নেই। তবে ছেলেকে বাঁচাতে চাই, ছেলের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চাই। আপনারা আমার ছেলেকে বাঁচান। 

ঘরের বারান্দায় মাটিতে বসে ভাত খাচ্ছে শান্ত

ছাতিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, অসহায় পরিবারটির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে সহায়তা করা হবে। ওই ছেলেটাকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়ার চেষ্টা করব।

মিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিংকন বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি খুব কষ্টের। আমরা তাকে সহযোগিতা করব। তার জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ডের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তার চিকিৎসার প্রয়োজনীয় অর্থ জোগান দিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আমি জানাব।

আসুন শান্তর পাশে দাঁড়াই, তার চিকিৎসা সহায়তায় হাত বাড়াই, হয়তো সবার সহযোগিতায় বদলে যাবে শান্তর জীবন। সহযোগিতা পাঠাতে যোগাযোগ করুন শান্তর বাবা জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তার মোবাইল নম্বর: (০১৯২৩০৭৪৭০৭)।

এএম