করোনার ভয়াবহ তাণ্ডবে মানুষ যখন ঘরবন্দী, তখনও টিফিনের বাটি নিয়ে সকাল সকাল কাজে যেতেন পোশাকশ্রমিকরা। মেশিনের চাকার সাথে সাথে ঘুরিয়েছেন অর্থনীতির চাকাও। তবে আজ সেই শ্রমিকরাই হলুদ ট্রেড ইউনিয়নের খপ্পরে চাকরি হারিয়ে দিশেহারা। কোনো অপরাধ না করেও শুধুমাত্র অসাধু শ্রমিক নেতার হলুদ ট্রেড ইউনিয়নের খপ্পরে আজ চাকরিহারা হাজারো শ্রমিক।

সম্প্রতি শ্রম অধিদফতরে এমন হলুদ ইউনিয়ন জমা দিয়েছেন বাংলাদেশ তৃণমূল গার্মেন্টস কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি শামীম খান। আশুলিয়ার জামগড়ার উচ্চ ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার ৯ জন শ্রমিকের একটি কমিটি করে এই ট্রেড ইউনিয়ন জমা দেন তিনি। তবে নিয়ম অনুযায়ী ৯ জন শ্রমিকেরই বিষয়টি জানা ও সম্মতি থাকার কথা থাকলেও এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানতেন না। শ্রমিকের কাছ থেকে প্রতারণা করে আইডি কার্ডের ছবি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন জমা দেওয়ায় শ্রমিক নেতা শামীম খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন সেই শ্রমিকরাই।

অভিযোগে বলা হয়, শ্রমিক নেতা শামীম খানের নিয়োগ দেওয়া এজেন্টরা বিজিএমইএ থেকে ফ্রি চিকিৎসা সেবার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার কথা বলে শ্রমিকদের আইডি কার্ডের ছবি নেন। পরবর্তীতে তাদের নাম ও পদবি ঠিক রেখে জাল স্বাক্ষর ও বাবা-মায়ের গায়েবি নাম বসিয়ে শ্রম অধিদফতরে ট্রেড ইউনিয়ন জমা দেন। শ্রমিকদের অনুমতি না নিয়েই এমন হলুদ ইউনিয়ন জমা দেওয়ায় আশুলিয়া থানায় তারা অভিযোগ দায়ের করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু উচ্চ ফ্যাশন নয়, শ্যামস অ্যাটওয়্যার লিমিটেড, কালার সিটি লিমিটেড, মতি স্পিনিং মিলস, ডেই ইউ ফ্যাশন লিমিটেড, ডিজাইন টেক্স সোয়েটার লিমিটেড, স্পারো অ্যাপারেলস লিমিটেড, টার্গেট ফ্যাশন লিমিটেড ইউক্রেডিবল অ্যাপারেলস লিমিটেডসহ অসংখ্য পোশাক কারখানার শ্রমিকদের প্রতারণার মাধ্যমে আইডি কার্ড সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন শামীম খানের এজেন্টরা। এ ছাড়া শুধুমাত্র আশুলিয়া থানায় শাশীম খান এমন ৪৭টি হলুদ ইউনিয়ন জমা দিয়েছেন বলে দাবি আরেক শ্রমিক নেতার। পরবর্তীতে সেই সব কারখানা থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম বন্ধ করে দেন বলে দাবি করেন শ্রমিক নেতারা।

বাংলাদেশ তৃণমূল গার্মেন্টস কর্মচারী ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে কমিটির নামে এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া রয়েছে। যেখানে বেশ কয়েকজন করে সক্রিয় সদস্য থাকে। যারা শ্রমিকদের ভুল বুঝিয়ে কারখানার আইডি কার্ডের ছবি সংগ্রহ করেন। নয় শ্রমিকের আইডি কার্ডের ছবি সংগ্রহ হলেই বিধিবাম। ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে জমা দেন ট্রেড ইউনিয়ন। কারখানা কতৃপক্ষের ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি অনিহা থাকায় সুযোগ নেন এসব অসাধু শ্রমিক নেতারা। ট্রেড ইউনিয়ন জমা হলেই মালিক পক্ষের সাথে রফাদফা করে পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ফলে কারখানায় আর ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয় না বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।

বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আইবিসির সাভার আঞ্চলিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে ট্রেড ইউনিয়ন বলতে আমরা বুঝি, শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা ও কারখানা কর্তৃপক্ষের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টিকারী এবং শ্রমিক শ্রেণির কল্যাণে আইন স্বীকৃত সংগঠনই হলো ট্রেড ইউনিয়ন। যার স্বীকৃতি শ্রম আইন দিয়েছে। শ্রমিকরা চাইলে বৈধভাবে এই ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবেন। এখানে অন্যকারও এ ইউনিয়ন করার এখতিয়ার নেই। কিন্তু শামীম খাঁন আইডি কার্ড সংগ্রহ করে শ্রমিকদের না জানিয়ে উচ্চ ফ্যাশন লিমিটেড কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন জমা দেন। একই ঘটনা ঘটিয়েছেন গাজীপুরের আহসান কম্পোজিট কারকানায়। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। একই সাথে ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি শ্রমিকসহ সুশিল সমাজ আস্থা হারিয়ে ফেলেন। যা প্রকৃত ও গঠনমূলক ট্রেড ইউনিয়নের জন্য অশনি সংকেত।

হলুদ ট্রেড ইউনিয়ন সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, হলুদ ট্রেড ইউনিয়ন হলো গোপনে একটি কারখানার কমপক্ষে ৯ জন শ্রমিকের আইডি কার্ড সংগ্রহ করেন অসাধু শ্রমিক নেতারা। পরে আইডি কার্ড অনুযায়ী শুধু নাম পদবি ঠিক রেখে ভুলভাল বাবার নাম, ঠিকানা ও ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে কাগজ প্রস্তুত করে জমা দেয়। জমা দেওয়ার পর কারখানায় একটি চিঠি আসে। চিঠি আসা মাত্র কারখানা কতৃপক্ষ ট্রেড ইউনিয়ন বন্ধে তোড়জোড় শুরু করে। আর এ কাজে সহযোগিতা করেন খোদ শ্রম অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তারা। এসব ইউনিয়ন যে হলুদ তা কারখানা কতৃপক্ষ খবরও রাখেন না। পরবর্তীতে অসাধু শ্রমিক নেতা সেই কারখানা কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ট্রেড ইউনিয়ন না করার শর্তে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়। এর বিনিময়ে প্রস্তুতকৃত কাগজের এক কপি কারখানা কতৃপক্ষকে দেওয়া হয়। কাগজ পত্রে যে সকল শ্রমিকের নাম থাকে তাদের কৌশলে ছাঁটাই করে কারখানা কতৃপক্ষ। এরপর থেকে শ্রমিক নেতার হদিস পাওয়া যায় না। এক সময় ইউনিয়নটি প্রত্যাখান করে শ্রম অধিদফতর। যে সকল ইউনিয়ন প্রত্যাখান হয়েছে প্রতিটি ইউনিয়নে চাকরি হারিয়েছে ৯ অথবা ১১ জন করে।

শ্রম অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত ট্রেড ইউনিয়ন প্রত্যাখান হয়েছে ৫৭৯টি। শ্রমিক নেতার ভাষ্য অনুযায়ী ৫৭৯টি প্রত্যাখিত ইউনিয়নের কারণে এ পর্যন্ত চাকরি হারিয়েছে ৫ হাজার ২১১ জন শ্রমিক। যাদের কেউ হয়তো কষ্টে যোগাড় করেছেন চাকরি, কেউবা হয়েছেন রিকশা চালক।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক নেতা বলেন, শামীম খান দীর্ঘদিন ধরেই এই কাজই করেন। তার প্রধান কাজই হলুদ ট্রেড ইউনিয় জমা দেওয়া। এই ট্রেড ইউনিয়ন জমা দিয়ে মালিকের সাথে সমাধান করেন তারা। এভাবেই চাকরি হারিয়ে ভ্যান রিকশা চালক হিসাবে জীবনযাপন করছেন অনেক শ্রমিক।

এমন একজন শ্রমিক হালিম, তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ট্রেড ইউনিয়ন কী এটা জানতাম না। চাকরি যাওয়ার দিনই নামটা শুনেছিলাম প্রথম। পেটের দায়ে কারখানায় আসতাম, কাজ করতাম। কিন্তু সেই ইউনিয়ন নাকি আমিই জমা দিয়েছিলাম। এ দায়ে আমার চাকরিটা গেল। পরে শুনলাম কোনো এক শ্রমিক নেতা আমার আইডি কার্ডের ছবি নিয়ে এই ইউনিয়ন জমা দিয়েছিলেন। আমি চাকরি হারিয়ে আজ অসহায়। আল্লাহ যেন ওই নেতার বিচার করেন।

আইবিসি সাভার আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি ও স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আল-কামরান বলেন, এ ধরনের অসাধু চক্র পোশাক খাতে অশনি সংকেত। তারা কখনও পোশাক খাতের ভালো চায় না। শুধু ব্যস্ত থাকে নিজের আখের গোছাতে। এদের লাগাম এখনই টানতে হবে, নইলে পোশাক খাতের ওপর বড় প্রভাব পড়তে পারে।

এ ব্যাপারে উচ্চ ফ্যাশনের অ্যাডমিন ম্যানেজার সায়েম রুমি বলেন, আসলে এটা একটি চক্র। এর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও জড়িত। তারা কিছু অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্যই ভুয়া ট্রেড ইউনিয়ন জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের শ্রমিকরা সচেতন হওয়ায় ঘটনা জানার পরই থানায় অভিযোগ করেছেন এবং শ্রম অধিদফতরে অব্যাহতি পত্র পাঠিয়েছেন। ট্রেড ইউনিয়ন জমা দেওয়ার পর কারখানায় লেবার ইন্সপেক্টর এসেছিলেন। কেনো এসেছেন তাদের কাছে প্রশ্ন করলে বলেন, তারা কারখানা বন্ধ না খোলা এটা দেখতে এসেছেন। তিনি আরও বলেন, এসব শ্রমিক নেতার কারণেই কারখানা কতৃপক্ষ বাধ্য হয়ে নিজেরাই কৌশলে ট্রেড ইউনিয়ন করছেন। সেসব কারখানার ইউনিয়নগুলোও হলুদ। প্রায় কারখানায় ইউনিয়ন রয়েছে কিন্তু শ্রমিকরা জানেনই না। অথচ এই ইউনিয়ন করার অধিকার শুধু শ্রমিকদেরই।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত শামীম খান বলেন, শ্রমিকরা যখন কোনো কারখানার ইউনিয়ন করেন তখন মালিকরা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করেন। যাতে ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত না হয়। মালিকরা বিভিন্ন ভাবে ভয়ভীতি দেখান। আপনারা দেখেছেন ইউনিয়ন করার কারণে অনেক শ্রমিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন। শ্রমিকদের ভুলভাল বুঝিয়ে চাকরির ভয় দেখিয়ে অনেক মালিকই সফল হন। মালিকরা ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এর সাথে কিছু নামধারী শ্রমিক নেতৃবৃন্দ আছেন যারা মালিকদের ষড়যন্ত্রে সহযোগিতা করেন। মালিকদের কিছু দালাল রয়েছে যারা টাকা খেয়ে শ্রমিকদের ক্ষতি করেন। আর যদি আপনারা নিউজ করেন, তাহলে আমার বক্তব্যটাও তুলে ধরবেন।

প্রসঙ্গত, এর আগেও গণমাধ্যমে ‘ট্রেড ইউনিয়নকে ঢাল করে টাকার পাহাড়ে অসাধু শ্রমিক নেতারা’ এমন শিরোনামে শামীম খানের কুকীর্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এখনও থেমে নেই পোশাক খাতের হুমকি এই শামীম।

মাহিদুল মাহিদ/আরআই