নদীপাড়োত জন্ম নেওয়াটা কি হামার অপরাধ?
‘সারাজীবন কষ্ট আর কষ্ট। নদীপাড়োত জন্ম নেওয়াটা কি হামার অপরাধ? সরকার চাইরোপাকে (সবখানে) উন্নয়ন করে, হামার এত্তি (এখানে) দ্যাকে না। তিস্তা নদীত একনা ভালো বাঁধ দরকার। আগোত শুনছি ভারতের সাথে তিস্তা চুক্তি হইবে। কিন্তু কামের কাম কিছুই হয় নাই। অ্যালা (এখন) ফির চীনের সাথে নাকি সরকার নদী শাসন (তিস্তা মহাপরিকল্পনা) করবে। এই রকম আশ্বাস দিইয়া হামাক প্রত্যেক বছর বানোত (বন্যা) মারি ফেলাওছেন বাহে।’
কথাগুলো বলছিলেন নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানো ফিরোজুল মিয়া। তিনি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের বাগেরহাট এলাকার বাসিন্দা। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর আবার নতুন করে বসতভিটায় ঘর গড়ার কাজে ব্যস্ত এই কৃষক। তার মতো গঙ্গাচড়ার নদী তীরবর্তী এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই এখন ঘর গোছানোর সঙ্গে আবাদি জমি আগলে রাখতে হাড়ভাঙা শ্রম দিচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
গত বুধবার (২০ অক্টোবর) ভারত থেকে ধেয়ে আসা উজানের ঢলে ভাটির বিস্তৃত তিস্তা অববাহিকায় বিপৎসীমার ৬০-৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল। মাত্র ১২ ঘণ্টার পানির স্রোতে তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে দেখা দেয় আকস্মিক বন্যা। ফুলেফেঁপে ওঠা তিস্তার বুক থেকে এর দুদিন পরই পানি কমতে শুরু করে। এতে বেশি ক্ষয়ক্ষতি লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলায় হলেও বাদ যায়নি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলাও।
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) সকালে উপজেলার লক্ষ্মীটারি, গজঘণ্টা ও কোলকোন্দ ইউনিয়নের বেশ কিছু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে আকস্মিক বন্যার ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়েছে। কোথাও পড়ে আছে বিধ্বস্ত বাড়িঘর। কোথাও আবার চরের বালুতে চাপা পড়ে আছে ফসলি খেত। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, বাঁশের সাঁকো সবই লন্ডভন্ড। বিবর্ণ তিস্তায় পানি কমলেও স্বস্তি ফেরিনি নদীপারের মানুষদের কষ্টভরা মনে।
লক্ষ্মীটারির বেশ কিছু চরে কেউ কাঁচি দিয়ে, কেউ কোদাল দিয়ে কাদার নিচ থেকে তুলছেন নষ্ট হওয়া ধানের শীষ। যদি অল্প হলেও কিছু চাল পাওয়া যায়! এ দৃশ্য শুধু গঙ্গাচড়ার নয়, তিস্তা অববাহিকার সবগুলোর জেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ এভাবেই ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে ব্যস্ত।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, কিছু খেত থেকে পানি সরে গেলেও এসব খেতে ফসল আবাদ নিয়ে শঙ্কিত তারা। পানি সরে যাওয়ার পরে কিছু কিছু ফসলে পচনও দেখা দিয়েছে। ফলে চরের চাষিরা ফসলে এবারও সফল হতে না পারার দুশ্চিন্তায় আছেন। হঠাৎ বন্যায় নষ্ট হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমির উঠতি আমন। বাদ যায়নি আগাম আলু, মিষ্টি কুমড়া, চিনাবাদাম ও শীতকালীন শাক-সবজিসহ নানা ফসল। লন্ডভন্ড খাদ্যশস্য এখন নতুন করে উৎপাদন করা কষ্টকর।
ছালাপাক গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদা বলেন, একদিনের বন্যায় ঘরবাড়ি ভেঙে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। দুদিন ধরে নতুন করে বাড়িঘরের কাজ করছি। এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাইনি। গরিবের দুঃখ বারো মাস। সারাবছর নদীর সঙ্গে যুদ্ধ করি। আবার কষ্ট করে ফসলও উৎপাদন করি। কেউ তো আমাদের দিকে দেখে না। শুধু আশ্বাস দিয়ে ভোট নেয়।
চর পূর্ব ইচলির মুদি দোকানি ইব্রাহিম মিয়া বলেন, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আগামীর দিনগুলো কীভাবে চলব? কীভাবে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করব? ভীষণ চিন্তায় আছি। ভারতের কারণে আমরা প্রতিবছর মাঠে মারা যাচ্ছি। কিন্তু সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এখন বাড়িঘর ঠিক করব, নাকি চাষাবাদ করব? ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। কাজের খোঁজে নিজ এলাকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
তিস্তার কোলঘেঁষা শংকরদহ গ্রামে দেখা যায় কয়েকজন মিলে বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া ঘরবাড়ি উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। তাদের একজন জয়নাল মিয়া। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তার কাছে যেতেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না তিনি। জয়নাল বলেন, ‘বাড়ির কাছের চরোত একনা আগাম আলু আর মিষ্টি কুমড়া নাগাচনু (চাষ করা) বাহে। শীতের সময় নয়া আলু তুলি বেশি দাম পাই, কিন্তু হঠাৎ বানোতে মোর সোগ আশা শেষ। অ্যালা আবাদসুবাদ (চাষাবাদ) সোগে বালুপানিত তলে আছে। পানি কমার পর বসতভিটাত আসছি। কিন্তু হামার থাকার ঘর কোনাও ভাঙ্গি গেইছে। মরার আগ পর্যন্ত হামাক বোধ হয় এমন কষ্ট করা লাগবে।'
এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি পোষাতে কার্যকর উপায় সে অর্থে জানা নেই স্থানীয় কৃষি বিভাগের। গঙ্গাচড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবার তিস্তাবেষ্টিত নিম্নাঞ্চল ও নদীর বুকে জেগে ওঠা চর এলাকায় ৩০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষসহ বিভিন্ন ফসল হয়েছে। এছাড়া ২৪ হেক্টর জমিতে আগাম জাতের আলু ও ৩৫ হেক্টর জমিতে মিষ্টি কুমড়া এবং ১ হাজার ৬৫৫ হেক্টর জমিতে ধান চাষাবাদ হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, নদী তীরবর্তী গ্রামে ৩০ হেক্টর জমিতে লাগানো ধান, মিষ্টি কুমড়া, বাদাম ও আলুর ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১ হাজার ৬০০।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে, রংপুর কৃষি অঞ্চলে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমির ধান, আলু, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। পানি কমে আসায় এখন ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমিগুলো একটু একটু দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত দেরিতে রোপণ করা ধানে কিছুটা পানি স্প্রে করলে অথবা এ সময়ে যদি হালকা বৃষ্টি হয়, তবে কিছু ফসল বাঁচানো এখনও সম্ভব।
এবার দফায় দফায় বেড়েছে তিস্তার পানি। সবশেষ আকস্মিক বন্যায় লন্ডভন্ড হয়ে গেছে তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চলের হিডেন ডায়মন্ড খ্যাত কৃষি। জরুরিভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য ভুর্তকি কিংবা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা না গেলে এই অঞ্চলে মহাবিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির ব্যর্থতা ও সরকার ঘোষিত তিস্তা নিয়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কালক্ষেপণ এ অঞ্চলের প্রতিবছর ক্ষয়ক্ষতি বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে গত সপ্তাহের আকস্মিক বন্যার পর তিস্তা তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলি খেতসহ অনেকের বসতভিটা তিস্তার পেটে চলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, এবারের বন্যায় হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি তিস্তার বালুর চরে চাপা পড়ে নষ্ট হয়েছে। নদীপাড়ের মানুষেরা এখন ঘরহারা, ভিটাহারা, উদ্বাস্তু। জরুরিভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ভুর্তকি কিংবা পুনর্বাসনের উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। না হলে কৃষিনির্ভর তিস্তা তীরবর্তী এলাকাগুলোতে মহাবিপর্যয় দেখা দেবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর