১৯৮৪ সাল থেকে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মন্তাজ স্লুলিজ বাজার খালে বসবাস করছে শতাধিক মানতা পরিবার। পরিবার-পরিজন সবাইকে নিয়ে মাছ শিকার এবং স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে চলে তাদের জীবন-জীবিকা। জলে ভাসা এই জনগোষ্ঠীর শিশুরা কখনোই লেখাপড়া কিংবা স্কুলে যেত না। ফলে নির্দিষ্ট গণ্ডিতেই বন্দি ছিল তাদের জীবন।

তবে বছর দুই আগে এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। মানতা পরিবারের ৬০ শিশুর জন্য বাংলাদেশি প্রবাসীদের অর্থে পরিচালিত ‘মুসলিম চ্যারিটি’ এবং স্থানীয় ‘জাগো নারী’ নামে একটি এনজিওর উদ্যোগে ২০১৯ সালে একটি বোট স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে।

এখানে প্রতিদিন শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হয়। ফলে সকাল হতেই মানতা পরিবারের মায়েরা শিশুদের বোট স্কুলে পাঠানোর জন্য রেডি করে মাছ শিকারে নেমে পড়েন। অনেক সময় মাছ শিকারে নৌকাগুলো নদীতে গেলে তাদের সঙ্গে সঙ্গে বোট স্কুলও নদীতে যায়।

জানা যায়, বংশপরম্পরায় মানতা সম্প্রদায়ের লোক নদী-নালায় বসবাস ও মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে। এ সম্প্রদায়ের শিশুরা কখনো পড়ালেখা শিখতে পারেনি। এখন তাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ভাসমান বোট স্কুল। বেসরকারি এনজিওর উদ্যোগে বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিক পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয় তাদের। তবে মানতা শিশুদের জন্য এবার সরকারি ব্যস্থাপনায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

ভাসমান বিদ্যালয়ে শিশু শিক্ষার্থী আলেয়া বলে, আমার স্কুলে আসতে ভালো লাগে। প্রতিদিন আমরা স্কুল আসি। এই স্কুলে পড়াশোনা করে অনেক বড় হব। শিশু মনিরা বলে, স্কুলে স্যার-আপা পাঠদানের পাশপাশি বিভিন্ন খেলাধুলা, গান, কবিতা ও ছড়া বলার সুযোগ করে দেন। আমরা স্কুলে অনেক আনন্দ করি।

ভসমান মানতা সম্প্রদায়ের সদস্য সেলিনা বলেন, এখানে আমরা যারা থাকি, যখন গাঙে মাছ ধরতে যাই, নিশ্চিন্তে যাই। আগে টেনশন হতো। আমাগো গুরাগারাগো (শিশুসন্তান) জমিনের স্কুলে ভর্তি নেয় না আমরা মান্তা (অচ্ছুত) বইলা। তিনি আরও বলেন, সকাল হতেই আমার ছেলে-মেয়ে বোট স্কুলে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। আমিও ওদের রেডি করে স্কুলে দিয়ে গাঙ্গে মাছ শিকারে যাই।

বোট স্কুলের প্রধান শিক্ষক আইয়ুব খান বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি পিছিয়ে পড়া এসব শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনার। অনেক সময় মাছ শিকারে নৌকাগুলো নদীতে গেলে তাদের সঙ্গে সঙ্গে বোট স্কুলও নদীতে যায়। আগামী ডিসেম্বরে আমাদের প্রকল্পের মেয়াদ শেষ। এরপর আর স্কুল চালানো সম্ভব হবে না।

তিনি আরও বলেন, তারা এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছে। কিন্তু আর কিছুদিন পর তা পারবে না। এ জন্য এসব শিশুর জন্য খারাপ লাগছে।

রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসফাকুর রহমান বলেন, ভাসমান মানতা শিশুদের জন্য নদীর পাড়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নদীভাঙন কিংবা দারিদ্র্যের কারণে বাড়িঘর-হারা এসব মানুষ একত্র হয়ে নদীতে বসবাস শুরু করছে প্রায় ৩০ বছর ধরে। এ কারণে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও এদের কারও ছিল না জাতীয় পরিচয়পত্র। যে কারণে সরকারি সহযোগিতা থেকে তারা বঞ্চিত হতো। তবে গত বছর মানতাদের মধ্যে ৫০ জনকে প্রথম ধাপে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান এবং এ বছর ৩০ পরিবারকে মুজিব বর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেওয়া হচ্ছে।

এনএ