ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ধরণী ধরদী গ্রামের জুবায়ের রহমান (১৯)। ২০২০ সালের এইচএসসি নির্বাচনী পরীক্ষায় পেয়েছিলেন জিপিএ-৫। আশাবাদী ছিলেন বোর্ড পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাবেন। কিন্তু করোনা মহামারি পরিস্থিতির জন্য পরীক্ষা না হওয়ায় অটোপাস হলো।  জিপিএ-৫ পাওয়া বন্ধুদের আনন্দ উল্লাস দেখে আশাহত হন জুবায়ের। ৪.৫০ পেয়ে ভেঙে পড়েন মেধাবী এ ছাত্র। অটোপাস তার স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়। সেদিন খুব কেঁদেছিলেন তিনি। এরপর মনকে শক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন জোরেশোরে। দেশসেরা তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি ইউনিটে কৃতকার্য হয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে সে।

জানা গেছে, ২০২০ সালের এইচএসসির অটোপাসে স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া জুবায়ের এবার স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন দেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি ইউনিটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এতে তার অটোপাশে আশাহত আর সেদিনের কান্না নিমিষেই দূর হয়ে গেছে।

দরিদ্র কৃষক বাবার ছেলে আব্দুল করিম শেখের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট জুবায়ের। রাজধানীর নামকরা স্কুল-কলেজে পড়তে পারেননি। পড়েননি জেলা কিংবা উপজেলার শহরেও। বাড়ি থেকে হেঁটে যেতেন স্কুলে। ২০১৮ সালে এয়াকুব আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেছেন ৪.৩৩ জিপিএ নিয়ে। 

এরপর তিনি বুঝতে পারলেন বিজ্ঞান শাখায় পড়ার জন্য যে অনুকূল পরিবেশ দরকার তা তার নেই। বাবার সামর্থ্য থাকলে ভর্তি হতে পারতেন ভালো কলেজে। তাই বাধ্য হয়ে ভর্তি হলেন বাড়ির পাশের কাদিরদী কলেজের মানবিক বিভাগে। কলেজের সব পরীক্ষায় প্রথম হতে থাকলেন।

২০২০ সালের এইচএসসির অটোপাসে সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন শিক্ষার্থী। দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলে আসন সংখ্যা ৭০ হাজার মাত্র। এসব পরিসংখ্যান মিলিয়ে ভেঙে পড়েন জুবায়ের। ভাবতেও পারেননি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন। সেই ছেলে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি ইউনিটে কৃতকার্য হয়েছেন।

তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অটোপাসের পর জুবায়ের ভেঙে পড়েন। এ সময় পরিবারের সদস্যরা তার পাশে ছিলেন। শিক্ষকরা তাকে শান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, তুমি পারবে।

সবাই বললেন ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে। এরপর রাজধানীর একটি কোচিং সেন্টারের অনলাইন ভর্তি প্রস্তুতি ক্লাস শুরু করেন বাড়িতে বসে। প্রচুর অধ্যাবসায় করতে থাকেন। শেষমেষ ফলাফলও পেলেন। এ বছর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এ ইউনিটে ১৩০তম, বি ইউনিটে ৫০০তম, সি ইউনিটে ১২৮তম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সি ইউনিটে ২৬১তম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ ইউনিটে ১৯৫৯তম এবং ঘ ইউনিটে ২৬১তম হয়েছেন। এরপর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেননি।

এ বিষয়ে জুবায়েরের সাথে কথা বললে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমিই আমার গ্রামের প্রথম শিক্ষার্থী যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। এটা আমার জন্য বিশ্বজয়ের মতো। অনেকের কাছেই এই অর্জন ছোট বা মামুলি হতে পারে কিন্তু আমার কাছে এটা যে কী আনন্দের তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

তিনি আরও বলেন, আমার গরিব বাবা আমাকে বড় কলেজে পড়াতে পারেননি। আমি বাড়ির পাশের কলেজে পড়েই এই ফলাফল করেছি। আমার জেদ ছিল আমাকে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতেই হবে। আমার সেই আশা পূরণ হয়েছে।

এ বিষয়ে জুবায়েরের বাবা আব্দুল করিম শেখ বলেন, আমার ছয় ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছোট ছেলেটার মাথা ভালো। ও অনেক কষ্ট করছে। তার ফলও পাইছে। আমি আমার ছেলের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।

জহির হোসেন/এসপি