বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বসবাস করেন আত্মীয়-স্বজনরা। তবে দেখা করার, গল্প করার ও একজন আরেকজনের বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে হলেও কোনো উপায় নেই। কারণ মাঝখানে আছে কাঁটাতারের বেড়া। যে বেড়া বাংলাদেশ-ভারতকে বিভক্ত করেছে। 

ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার ৬ নম্বর ভাতুড়িয়া ইউনিয়নের মাকড়হাট ক্যাম্পের ৩৪৬ পিলার সংলগ্ন টেংরিয়া গোবিন্দপুর গ্রামের কুলিক নদীর পারে ঐতিহ্যবাহী পাথরকালী মেলা উপলক্ষে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যুগ যুগ ধরে দুই বাংলার হাজারো মানুষ স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হন। পাথরকালী পূজার পরে ওই এলাকায় বসে মেলা। এই মেলাকে ঘিরে একদিনের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। দুই বাংলার মানুষ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন। আত্মীয়-স্বজনদের জন্য নিয়ে আসা জিনিসপত্র কাঁটাতারের ওপর দিয়ে ছুড়ে দেন। 

শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ওই মিলনমেলা হওয়ার কথা ছিল। সে অনুযায়ী বাঙালিরা স্বজনদের জন্য জিনিসপত্র নিয়ে কাঁটাতারের পাশাপাশি অবস্থান করেন। তবে তাদের সেখানে ভিড়তে দেওয়া হয়নি। 

সরেজমিনে দেখা যায়, এপারে প্রশাসনের তৎপরতা। কাঁটাতারের পাশে যেতে দেওয়া হচ্ছে না কাউকে। কাঁটাতারের পাশে যেতে না পেয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন স্বজনরা। 

নিজের ভাইকে দেখতে আসা আলী আকবর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপনজনদের দেখার জন্য এক বছর অপেক্ষা করে থাকি। নিজের ভাই থাকে পরিবারসহ ওপারে। গত বছরও দেখা করতে পারিনি। এবারে আশা ছিল ভাইয়ের মুখ দেখতে পারব। কিন্তু ভারতের প্রশাসন তা হতে দিল না। ওই দেশে বলে খুব ভাইরাস (করোনা) তাই আর দেখা হলো না। 

মেয়ের জন্য পিঠা নিয়ে আসা বৃদ্ধা সালেহা বেগম বলেন, এখন এই পিঠা কে খাবে? মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনির জন্য নিজের হাতে পিঠা বানিয়ে নিয়ে আসছি। কিন্তু পিঠা দেওয়া তো দূরের কথা, এক পলক দেখা করতেও পারলাম না। 

নীলফামারীর জলঢাকা থেকে ভারতে বসবাস করা ছেলেকে দেখতে এসেছিলেন বৃদ্ধা মধুবালা। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, টাকার অভাবে ভারতে যেতে পারি না, তাই খবর পেয়ে এলাম ছেলেকে দেখতে। না দেখেই ফিরে যাচ্ছি। প্রতি বছর যেন আমাদের মতো অভাবি মানুষদের জন্য সীমান্তে মিলনমেলার আয়োজন করা হয়।

পীরগঞ্জ থেকে আসা বাকলী রাণী, চন্দ চাঁদ রায়সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অনেকে বলেন, সকাল থেকে আমরা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষায় রয়েছি। দুপুর গড়িয়ে বেলা শেষের দিকে, তারপরও দেখা করতে পারছি না। করোনাভাইরাসের কারণে সব বন্ধ। আত্মীয়রা ওপারে অপেক্ষায় রয়েছে কাঁটাতারের কাছে আসতে পারছে না। এবার পূজা সম্পন্ন করেই বাড়ি যাব। আগামী বছর দেখা করার অপেক্ষায় রইলাম ।

পূজা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নগেন কুমার পাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে মিলনমেলা করা সম্ভব হয়নি, শুধু পূজা পালন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ভাতুঁড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাজান সরকার বলেন, করোনার কারণে দুই বছর ধরে মিলনমেলা হয়নি। দুই বাংলার এই সম্পর্ক যেন যুগ যুগ থাকে।

হরিপুর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পাথরকালী পূজা উপলক্ষে প্রতিবছর এই দিনে গোবিন্দপুর কুলিক নদীর পাড়ে কাঁটাতারের কাছে দুই সীমান্তে ইংরেজি মাস ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের শুক্রবার লাখো মানুষের সমাগমে ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশ-ভারত মিলনমেলা হয়ে থাকে। এবার করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে মিলনমেলার আয়োজন করা হয়নি। এতে কাঁটাতারের ওপারে থাকা আত্মীয়-স্বজনরা মিলিত হতে পারনেনি। করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রনের কারণে এবার সীমান্তের কাঁটাতারের কাছে কোনো মানুষকে ভিড় জমাতে দেয়নি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।

হরিপুরের গোবিন্দপুর ও চাপাসার ক্যাম্পে কর্মরত বিজিবি সদস্যরা জানান, করোনার কারণে মিলনমেলা বন্ধ করে দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। কাঁটাতারের কাছে কোনো বাংলাদেশি যেন না যায় সে বিষয়ে আমাদের অনুরোধ করা হয়েছে। 

আরএআর