গভীর রাত! নগরীজুড়ে সুনসান নীরবতা। বাসা-বাড়ি, পাড়া-মহল্লা, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের প্রধান ফটক বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছেন সবাই। কিন্তু অন্যের সম্পদ রক্ষা ও ঘুম নির্বিঘ্ন রাখতে জেগে থাকতে হয় নৈশপ্রহরীদের। বছরের পর বছর রাতজাগা কাজের যে পারিশ্রমিক মেলে, তা খুবই সামান্য। তারপরও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই স্বল্প বেতনে বাধ্য হয়েই নিরাপত্তা চাকরি করছেন নৈশপ্রহরীরা।

মাদারীপুর শহরের পুরান বাজার সিটি প্লাজা মার্কেটের নৈশপ্রহরী কেরামত আলী জমাদ্দার (৭০)। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি একাই। চার মেয়েকেই লেখাপড়া করিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করে এখন চাকরিপ্রত্যাশী। বার্ধক্য ও শারীরিক নানা সমস্যা নিয়েও পরিবারকে ভরণপোষণ দিতে তিন বছর ধরে এখানে কাজ করছেন।

কেরামত আলী জমাদ্দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বয়সের কারণে ভারী কাজ করতে পারি না। হার্টের সমস্যা, তাই মাসে তিন হাজার টাকার ওষুধ লাগে। যা পাই তাই দিয়ে অনেক কষ্ট করে সংসার চালাই।

তিনি মাদারীপুর সদর ঘটমাঝি ইউনিয়নের ভদ্রখালী এলাকার বাসিন্দা। স্ত্রী তাজিয়া বেগম ও চার মেয়ে ছালমা বেগম, রেশমা বেগম, সিমা বেগম ও মিষ্টি আক্তারকে নিয়ে তার সংসার।

কেরামত আলীর জীবনের বড় অংশজুড়ে আছে হতাশা। ৮ ঘণ্টা রাত জেগে ৭ হাজার টাকা বেতন মিলছে তার। এর আগে তিনি বিভিন্ন জায়গায় নৈশপ্রহরীর কাজ করেছেন। যুবক বয়সে কেরামত আলী খুলনায় স্টার জুটমিলে ৩০ বছর চাকরি করেছেন। পরবর্তীতে পাটকলের মালিক কয়েক মাসের বেতন আটকে দেওয়ায় শ্রমিকদের নিয়ে আন্দলন করায় চাকরি হারান তিনি। এরপর অন্য কোনো কাজ খুঁজে পাননি তিনি। ২০ বছরের অধিক সময় পার করেছে নৈশপ্রহরীর কাজ করে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুর শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় শতাধিক নৈশপ্রহরী রয়েছেন। তাদের বেশির ভাগ বয়স্ক ও বৃদ্ধ। অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করছেন। বয়স বেড়ে যাওয়ায় শারীরিক সক্ষমতা না থাকায় কাজের ক্ষেত্র খুবই সীমিত তাদের। তা ছাড়া আরও বিভিন্ন ধরনের সমস্যাও রয়েছে তাদের। ফলে অন্য কাজ না পাওয়ায় খুব কম বেতনে বাধ্য হয়েই নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি করছেন তারা।

কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিরীহ-বিপদগ্রস্ত এসব বিশ্বস্ত প্রহরীর বেতনও বাড়ায় না বাড়ির মালিক ও কোম্পানিগুলো। বিশেষ দিনেও নেই কোনো ছুটি। যেখানে জানমালের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এসব প্রহরীর রয়েছে জীবনের ঝুঁকি, সেখানে চোর, ডাকাত, ছিনতাইয়ের মতো ঝামেলা এড়াতে বাঁশি আর লাঠি ছাড়া তেমন কোনো হাতিয়ার নেই। কখনো কখনো হামলার শিকার হতে হয়। এ সময় কঠিন বিপদের মুখোমুখি এমনকি প্রাণহানিও হয় তাদের। এরপরও পরিবারকে একটু খাওয়াতে-পরাতে বাধ্য হয়ে রাতজাগার চাকরি করেন তারা।

সরেজমিনে মধ্যরাতে মাদারীপুর শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা যায়, রাস্তার দুপাশের ল্যাম্পপোস্ট ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটকে জ্বলছে আলো। ঘুমন্ত নগরীজুড়ে সুনসান নীরবতা। কিছু সময় পর পর বাঁশি দিয়ে আওয়াজ করে বা হাঁকঢাক দিয়ে নৈশপ্রহরীরা তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। তন্দ্রা এলেই গানের আওয়াজে নিজেকে সজাগ রাখছেন তারা। বাসা-বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, এটিএম বুথের সামনে চলছে তাদের নির্ঘুম রাতযাপন।

সিটি প্লাজা মার্কেটের পাশেই রয়েছে ডাচ-বাংলা এ টি এম বুথ। সেখানে ৮ বছর ধরে নৈশ পাহারার কাজ করে যাচ্ছেন ৭২ বছর বয়সী আব্দুর রহিম বেপারী। তিনি মাদারীপুর সদর পৌরসভা হাজিরহাওলা ৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। স্ত্রী দেলোয়ারা বেগম এবং এক ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে তার সংসার। তিন মেয়েরই বিয়ে হয়েছে। ছেলে ইলিয়াস বেপারী (৩০) বিএ পাস করেছেন। কিন্তু দৃষ্টিপ্রতিবন্দী হওয়ায় কোনো কাজই করতে পারছেন না তিনি। ফলে বৃদ্ধ বয়সে এসেও আব্দুর রহিম বেপারীকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতনে প্রতিদিন তাকে ১০ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। বিষেশ দিনেও নেই কোনো ছুটি।

আব্দুর রহিম বেপারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বয়স হইয়া গেছে, ঘরে একটা ছেলে আছে প্রতিবন্ধী। সে বিএ পাস করেছে। তারপরও চাকরি পায় না। তাই আমাকেই কাজ করতে হয়। মাত্র ৬ হাজার টাকা বেতন দেয় মালিক। খুব কষ্ট কইরা সংসার চালাই। ২৪ ঘণ্টাই আমার ডিউটি করা লাগে এখন।

কিছুদূর সামনে এগিয়ে শহরের কাজীর মোড় এলাকায় গিয়ে দেখা মিলে নৈশপ্রহরী ফজেল হক মাতুব্বরের সঙ্গে। এক হাতে বল্লম ও অন্য হাতে টর্চলাইট জ্বালিয়ে এদিক-সেদিক দেখছেন আর পায়চারী করে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন। বয়স ৬০ বছর পেরিয়েছে তার। অন্য কোনো কাজ করতে না পরায় রাতজাগা পেশাকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। ২০টি দোকান রাতে পহারা দিয়ে ৯ হাজার টাকা বেতন পান তিনি।

মাদারীপুর সদর পুরাতন ফেরীঘাট এলাকা বাসিন্দা মৃত আফতাফ হোসেনের ছেলে ফজেল হক মাতুব্বর। স্ত্রী রজিনা বেগম, ছেলে রিমন ইসলাম (১৮) ও মেয়ে রিয়ন আক্তারকে (১২) নিয়ে তার সংসার। সংসারের ভরণপোষণ ও ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার খরচ চলে তার ৯ হাজার টাকা বেতনে।

বজ্রপাতে বাবার মৃত্যু হয়। তখন তার ৮ বছর বয়স। সংসারের হাল ধরতে তখন থেকেই তিনি জাহাজের শ্রমিকের কাজ করতেন। দীর্ঘ ৫০ বছর কাজ করেছেন সেখানে। দুবছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আর কাজে ফিরে যেতে পারেননি তিনি। পরে বাধ্য হয়ে নৈশপ্রহরীর কাজ বেছে নেন তিনি। 

ফজেল হক মাতুব্বর ঢাক পোস্টকে বলেন, এখানে নাইট গার্ডের চাকরি করি। বেতন কম পাই। আমাদের কোনো নিরাপত্তা নাই। সারা রাত জেগে ডিউটি করতে হয়। কোনো আপদ-বিপদ হলে কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদের জন্য কিছু করতেন, তাহলে শেষ জীবনটা ভালোভাবে কাটাতাম।

শহরের চৌরাস্তা এলাকায় যাওয়া মাত্রই কানে ভেসে আশে নৈশপ্রহরী মো. বোরহান হোসেনের (৩২) হাঁকঢাক। কথা হয় তার সঙ্গেও। বোরহান হোসেন মাদারপুর সদর ঝাউদী ইউনিয়নে মাদ্রা এলাকার মকবুল হোসেনের ছেলে। বাবা মকবুল হোসেন একজন রিকশাচালক। চার ভাই ও এক বোন তরা। বাবা ও তার চার ভাই দিনমজুরের কাজ করেন। কিন্তু শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকায় তিনি ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই রাতজাগার চাকরিকে বেছে নিয়েছেন।

স্ত্রী নারগিস আক্তার ও তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার আলাদা সংসার। চৌরাস্তা এলাকায় ২৭টি দোকান পাহারা দিয়ে ৯ হাজার টাকা বেতন মিলে তার। তা দিয়েই কোনোমতে চলছে তাদের সংসার।

মো. বোরহান হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। তাই ভারী কাজ করতে পারি না। যেই বেতন দেয়, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। শীতের রতে বেশি কষ্ট হয়। গরমের রাতেও কষ্ট হয়। যা বেতন পাই, তাই দিয়াই বউ-পোলাপান লইয়া কষ্ট করে চলতে হয়।

মানবাধিকার কর্মী সুবল বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদারীপুর শহরে বিভিন্ন সেক্টরে যেসব নৈশপ্রহরী আছেন, তাদের অধিকাংশকেই দেখা যাচ্ছে বয়স্ক। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তারা যে বেতন পান, তা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। তারা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করেন। আমরা ঘুমিয়ে থাকি, তারা আমাদের পাহারা দেন। অথচ তারাই সমাজে অবহেলিত। আমার একটাই দাবি, তাদের যেন ভালো বেতন দেওয়া হয়, তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের দিকে একটু নজর দেওয়া।

মাদারীপুর সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং জেলা বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম তুষার ভূইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা তাদের নিয়োগ দেন, বেতন দেন। আমরা বণিক সমিতি থেকে কোনো নাইট গার্ডকে বেতন দিই না। এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে কিছু করারও নেই।

এনএ