ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে মুন্সিগঞ্জে টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে পানির নিচে তলিয়ে গেছে আলু চাষিদের স্বপ্ন। এতে সদ্য রোপণ করা আলু বীজ পচে নষ্ট হয়ে যাবে বলে চাষিরা আশঙ্কা করছেন।

মঙ্গলবারও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। এর আগে শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত টানা ৩ দিনের বৃষ্টিতে কৃষকের জমি এখন পানিতে থৈ থৈ করছে। অনেকস্থানে কৃষক সেচ যন্ত্রের মাধ্যমে ও নালা কেটে জমি থেকে পানি অপসারণের চেষ্টা করছেন। কিন্তু উঁচু জমিগুলোর নালা কেটে পানি অপসারণের সুযোগ থাকলেও নিচু জমিগুলোতে বইছে পানির ঢেউ। 

পানি নিষ্কাশনের স্থানটুকুও নেই। এতে কৃষকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। এমনকী আলুর জমির পানির মধ্যে নেমে কান্নাও করছে কৃষক। 

গত বছর আলুতে বিপুল পরিমাণ লোকসানের পর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষক যখন ধার-দেনা করে আলু আবাদ শুরু করেছেন, তখন টানা এই তিন দিনের বৃষ্টিতে জমিতে পানি জমে আলুবীজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আলু উৎপাদনকারী এই জেলায় এ বছর ৩৭ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করা হবে বলে মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

এ পর্যন্ত ১৭ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে আলু আবাদ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমির আলু এখন পানির নিচে।

এক্ষেত্রে মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের তিনটি উপদেশ দিয়েছে।


১. যে জমিগুলোতে পানি জমে গেছে সেগুলোতে ড্রেন কেটে পানি বের করে দেওয়া।
২. যে সমস্ত জমিতে ইতোমধ্যে আলু গাছ গজিয়েছে সেই সমস্ত জমিতে ছত্রাকনাটক স্প্রে করা।
৩. বৃষ্টিপাত ক্লিয়ার না হওয়া পর্যন্ত আর কোনো জমিতে আলু আবাদ না করা।

সরেজমিনে দেখা গেছে- মুন্সিগঞ্জ সদর, টঙ্গিবাড়ী, শ্রীনগর, গজারিয়া ও সিরাজদিখান উপজেলার বিস্তীর্ণ কৃষি জমিতে ইতোমধ্যেই রোপন করা হয়েছে আলু। রোপন করা ওই জমিগুলোর আলুর আইলের মধ্যে এখন পানি ভাসছে। আর যে সমস্ত জমিগুলোতে এখনো আলু রোপন করা হয়নি ওই জমিগুলো অধিকাংশই চাষ করে রাখা হয়েছে আলু আবাদ করার জন্য। হঠাৎ অনাকাক্ষিত এ বৃষ্টির পরে আবার নতুন করে জমি শুকিয়ে আলু আবাদ করতে ১৫ দিন চাষাবাদ বিলম্বিত হবে। এতে করে আলু উৎপাদন ২০ থেকে ২৫ পারসেন্ট কম হবে বলে জানান কৃষক।

অন্যদিকে, রোপন করা আলু বীজ পচে যাওয়ায় বীজ সংকট দেখা দেবে। এতে করে সর্ম্পূণ জমিতে আলু আবাদ করা এ বছর আর সম্ভব হবে না।

চরকেওয়ার ইউনিয়নের কৃষক মনসুর মাদবর (৩৫) বলেন, আমি গত ১ সপ্তাহে ১২৬ শতাংশ জমিতে ডায়মন্ড আলু আবাদ করেছি। বৃষ্টিতে আমার আলু খেতে পানি জমে গেছে। আমার এ জমিতে আলু আবাদে প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বৃষ্টির কারণে অধিকাংশ ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। সরকারি সহায়তা না পেলে নতুন করে আমার পক্ষে আর আলু চাষ করা সম্ভব হবে না।

কামাল শেখ নামে আরো এক আলু চাষি জানান, জানি ডুবে যাওয়া জমির পানি সেচে কোনো লাভ হবে না। তারপরও মনকে মানাতে পারছি না। গত বছর লোকসান হয়েছে। এ বছর ধার দেনা করে চাষে নেমেছিলাম। ভেবেছিলাম এ বছর দাম ভালো পেলে লোকসান পুষিয়ে নিতে পারব। কিন্তু শুরুতেই এমন হয়ে গেল। কথাগুলো বলতে বলতে তার গলা ধরে আসে। 

তিনি আরো জানান, প্রায় ৭ বিঘা জমিতে তিনি আলু চাষ করেছেন। প্রতি বিঘাতে সার-বীজ-শ্রমিক ও জমির দামের পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় লাখ টাকা। এখন জমির পানি নেমে গেলেও সার-বীজ-শ্রমের পেছনে নতুন করে খরচ হবে। এই টাকা কোথায় পাব?

ফরিদ হোসেন জানান, জমির দিকে তাকালে কষ্টে এমনিতেই চোখে পানি চলে আসে। পানি নেমে গেলে নতুন করে বীজ আলু পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। অনেকে হয়তো এই বছর আর আলুর আবাদ করতে পারবে না।

এদিকে কাটাখালী এলাকার কৃষক ইস্তিয়াক মাহমুদ (৩৮) বলেন, ২০ গন্ডা (১৪৪ শতাংশ) জমিতে গত বুধবার আলু আবাদ করেছিলাম। আমার খেতের আলু বীজ নষ্টের পথে। আবার নতুন করে লাগাতে হবে। এখন আলু বীজের দাম বেশি পড়বে। সারের দাম এবার এমনিতেই বেশি। 

গজারিয়া উপজেলার একাধিক কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, গত বছর তারা আলু চাষ করে তেমন লাভ করিতে পারেননি। তার ওপর যারা হিমাগারে আলু রেখেছে তাদের লাভের তুলনায় লোকসান গুনতে হয়েছে অনেক। 

গজারিয়া উপজেলার টেংগারচর ইউনিয়নের আলু চাষি মো. লুৎফর রহমান, মোহম্মদ হোসেন, শাহ আলী ও মীর্জা এমনটাই জানান।লুৎফর জানান, তার নয় লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

টঙ্গিবাড়ীর চর ছটফটিয়া গ্রামে গিয়ে আলু চাষি মো. মমিন শেখের (৪৩) সঙ্গে কথা বললে তিনি আবেগে কেঁদে ফেলেন। পরে বলেন, গত বছর আলু চাষ করে অনেক লোকশান হলেও এবার ঋণ করে আলু বীজগুলো লাগিয়েছিলাম। জানি না কী হবে?

এমএএস