টানা তিন দিন বৃষ্টির পর মুন্সিগঞ্জের আলুচাষিদের কোদাল হাতে জমির দিকে ছুটতে দেখা যায়। এ সময় জমিতে নালা কেটে পানি অপসারণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তারা। কোন দিকে পানি অপসারণ করবেন, তা নিয়ে পড়েন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। কারণ চারদিকেই তো থইথই পানি। অনেক নিচু জমি দেখলে বোঝার উপায় নেই, এটা কী জমি নাকি নদী বা খাল।

সরেজমিনে বুধবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে দেখা যায়, সকালে সূর্য ওঠার পরই কোদাল হাতে ছুটতে দেখা যায় রতন মোল্লা, সাহানাজ, সত্তার, আজিজ ব্যাপারীদের। সবাই নিজ জমি থেকে পানিনিষ্কাশনের জন্য কোদাল হাতে নালা কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

জমির আইলে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছিলেন শাহনাজ। টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সাতুল্লা এলাকায় তার বাড়ি। তিনি হল্যান্ড থেকে আমদানি করা বাক্সভর্তি বীজ আলু (৫০ কেজি) ৭ হাজার টাকা করে কিনে জমিতে রোপণ করেছিলেন। তার সেই আলুবীজ এখন পানির নিচে। ওগুলো সব নষ্ট হয়ে যাবে।

শাহনাজ বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুদের টাকা নিয়ে আলু রোপণ করেছিলাম। বৃষ্টিতে সব আলু নষ্ট হয়ে গেল। এখন সুদের টাকা কোথা থেকে দেব? জমিতে আবার কোথা থেকে আলু কিনে রোপণ করব? নতুন আলুর বাক্সের দাম বেড়ে এখন তা ১২ হাজার টাকা হয়েছে। আলুইবা কিনব কীভাবে?

এলাকার আরেক আলুচাষি রতন মোল্লা জানান, এ বছর ১০ কানি (১৪৪০ শতাংশ) জমি আলু চাষের জন্য প্রস্তুত করেছিলাম।
ইতিমধ্যে পাঁচ কানি জমিতে আলু রোপণ করে ফেলেছি। আলুগুলো সব পানিতে তলিয়ে গেছে । এখন বিজ কেনার মতো টাকা নেই। বীজের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সরকারি সহায়তা না হলে আলু লাগাতে পারব না।

সরোজমিনে মুন্সিগঞ্জ সদর ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলায় দেখা যায়, টানা তিন দিন বৃষ্টির পর কৃষকের সাড়ে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে এখন পানি থইথই করছে। সকাল থেকে উদ্বিগ্ন কৃষক কোদাল হাতে ছুটছেন পানিনিষ্কাশনের জন্য। টঙ্গিবাড়ী উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রাম এলাকায় বেশ কিছু জমির দিকে তাকালে মনে হয় যেন মধ্য বর্ষা চলছে। আলু জমিগুলোর মধ্যে পানিতে এখন মাছ খেলা করছে।

ওই এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া তাদের জমিগুলো শুকাতে আরও ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লেগে যাবে। তত দিনে আলু রোপণের মৌসুম শেষ হয়ে যাবে। এ বছরই ওই জমিগুলোতে আর আলু রোপণ করা সম্ভব হবে না।

এর আগে ঘূর্ণিঝড়‌ জাওয়াদের প্রভাবে শনিবার সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয় সারাদেশে। টানা বৃষ্টির ফলে আলুর জমি তলিয়ে যায় পানির নিচে। এতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন আলুচাষিরা।

মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার যোগিনীঘাট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত অধিকাংশ জমিতে আলু লাগানো হয়ে গেছে আর কিছু জমি রোপণের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে আলুর জমিগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জমিতে পানি জমে থাকায় নতুন করে আলু রোপণ করা যাচ্ছে না আর যে জমিতে রোপণ করা হয়েছে, সেই জমিগুলো ভিজে পানি জমে আছে। এতে রোপণকৃত আলু পচে যাওয়ার শঙ্কায় আছেন আলুচাষিরা। 

আলুচাষি বাদশা বেপারি বলেন, এবার আমি পাঁচ বিঘা জমিতে আলু লাগাইছি। আরও ৫ বিঘা জমিতে সার ফেলে চাষ দিয়ে প্রস্তুত করে রাখছি। কিন্তু টানা দুদিনের বৃষ্টিতে আমার সব জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ বছর আলু আর লাগাতে পারব কি না তাও জানি না। সবকিছুই শেষ হয়ে গেল। গত বছর আলু লাগিয়ে ন্যায্য দাম পেলাম না লোকসানে আলু বিক্রি করে একটু লাভের আশায় এবার আলু লাগাইলাম, তাও সব বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়ে গেল।

আলুচাষি আরিফ বলেন, আমি গত বছরের আলু বস্তাপ্রতি ৪০০ টাকা লোকসানে আলু বিক্রি করে এবারও ১৫ বিঘা জমিতে আলু লাগাইলাম। আরও ১৫ বিঘা জমি লাগানো বাকি আছে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে আমার সব শেষ হয়ে গেল। আমরা কৃষকরা এভাবেই মরব আমাগো দেখার কেউ নাই। এ দেশের সরকার কৃষকদের ক্ষতি, লোকসান কিছুই দেখে না।

মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষি অধিদফতরের উপপরিচালক মো. খুরশিদ আলম বলেন, এ বছর মুন্সিগঞ্জ জেলায় ৩৭ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৭ হাজার হেক্টরের কিছু বেশি জমিতে আলু আবাদ করা সম্পন্ন হয়েছে।

গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে নিচু এলাকায় যেসব জমি রয়েছে, সেসব জমির রোপণ করা আলু পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে আমরা কৃষকরা উপদেশ দিচ্ছি যে যেসব জমিতে পানি জমে গেছে, সেসব জমিতে ড্রেন কেটে পানি বের করে দিতে হবে। যেসব জমিতে ইতিমধ্যে আলু গাছ গজিয়েছে, সেসব জমিতে ছত্রাকনাটক স্প্রে করতে হবে।

ব.ম শামীম/এনএ