‘রাত ৩টার কিছু সময় পর প্রতিবেশীদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে বের হয়ে দেখি সুগন্ধা নদী আলোকিত। আশ্চর্য হলাম। জানতে পারলাম, লঞ্চে আগুন লেগেছে। আমার বাসা লঞ্চঘাট। এর আগেও লঞ্চে আগুন দেখেছি। কিন্তু কখনো সম্পূর্ণ লঞ্চ একসঙ্গে জ্বলতে দেখিনি। দাউ দাউ করে জ্বলন্ত লঞ্চটি স্রোতে পশ্চিমে নিয়ে যাচ্ছিল।’

কথাগুলো বলছিলেন ঝালকাঠি লঞ্চঘাটের জ্বালানি তেলের ব্যবসায়ী মো. এরশাদ। শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) দুপুরে কথা হয় তার সঙ্গে। 

এরশাদ বলেন, তাৎক্ষণিক কী করবো মাথায় আসছিল না। মানুষের কান্না, চিৎকার নদীর এপাড় থেকেই শুনছিলাম। বাতাসে ভেসে আসছিল পোড়া গন্ধ।

তিনি বলেন, আমার নিজের একটি ট্রলার আছে। ট্রলারের মাঝিকে ডেকে তুলে ট্রলার স্টার্ট দিতে বলি। ঘাটের আরও ১০/১২টি ট্রলার মাঝিকে এক করে লঞ্চের দিকে রওয়ানা হই। এদিকে লঞ্চঘাটের মসজিদের ইমাম এবং পাশের আরও একটি মসজিদের ইমামকে মোবাইলে জানাই যেন তারা মাইকিং করে এলাকাবাসীকে নদীর তীরে আসতে বলেন। কোনো যাত্রী যদি ভেসে যান বা তীরে সাঁতরে ওঠেন তাকে সাহায্য করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। দুই মসজিদ থেকে মাইকিং করে জানানো হয়। এরপর শত শত মানুষ নদীর তীরে এসে দাঁড়ান।

এরশাদ বলেন, একযোগে ১০/১২টি ট্রলার নিয়ে লঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছেও লঞ্চের সঙ্গে ট্রলার ভিড়াতে (নোঙর) পারছিলাম না। কারণ লঞ্চের বডি আগুনে লাল হয়ে গিয়েছে। আগুনের এতো উত্তাপ কমপক্ষে পঞ্চাশ গজ দূরে ট্রলার থামিয়ে ঘুরতে হয়েছে।

এই ব্যবসায়ী বলেন, যখন আমরা ট্রলার নিয়ে যাই তখনো লঞ্চের মধ্য থেকে মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসছিল। মানুষ পোড়া গন্ধ, বাতাসে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছিল না। এর মধ্যে লঞ্চঘাট এলাকার সবাই কাজ চালিয়ে যাই। আমরা প্রথম অবস্থায় ১৪ জনকে উদ্ধার করে ঝালকাঠির এপাড়ে এনে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠাই।

এরশাদ বলেন, আমরা যে ১৪ জনকে উদ্ধার করেছি তারা সবাই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। লঞ্চের মধ্যে আটকে পড়া কাউকে উদ্ধার করতে পারিনি আমরা। কারণ লঞ্চের কাছেই যাওয়া যাচ্ছিল না।

এরশাদের ট্রলারে উদ্ধার হওয়া যাত্রী ইকরামুল ইসলাম বলেন, আগুন লাগার পর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সেখানে কিছুক্ষণ সাঁতারের পর কয়েকটি ট্রলার আমাদের উদ্ধারে যায়। তখন উদ্ধারকারী ট্রলারে উঠে প্রাণে রক্ষা পেয়েছি।

রনি নামে আরেক যাত্রী বলেন, ২০ জনের মতো লোক যখন লঞ্চের সামনে ছিল তখনো আমি আগুনের মধ্যে লঞ্চে ছিলাম। এরপর আর পারছিলাম না। আমার চোখের সামনে একটা বাচ্চা আর একজনকে পুড়ে মারা যেতে দেখেছি। যখন আর পারছিলাম না তখন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পরে ১০/১২টি ট্রলার দেখি আমাদের দিকে আসছে। তারা এসে আমাকে উদ্ধার করেন।

তিনি আরও বলেন, যখন স্থানীয়রা উদ্ধার করছিল তখন কোনো ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আসেনি। আমাদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি লঞ্চঘাটে নিয়ে আসলে দেখি পুলিশের দুটি পেট্রল টিম আর কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ঘাটে এসেছে।

প্রসঙ্গত, ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ৩টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে এখন পর্যন্ত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে শতাধিক যাত্রী দগ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর