সপ্তাহের একটি দিনের অপেক্ষায় থাকেন রাজধানী ঢাকার বনশ্রী এলাকার প্রায় ৪ শতাধিক অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষ। দিনটি হলো শুক্রবার। এদিন জুমার নামাজের পরপরই এসব মানুষের জন্য সাধ্য অনুযায়ী খাবারের আয়োজন করে স্থানীয় সিটিজেন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (সিডিএফ) নামের স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন।

প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পরপরই বনশ্রীর ই-ব্লকের ৮ নম্বর রোডের জোহা টাওয়ারের সামনে মেহমানখানায় শুরু হয় খাওয়া-দাওয়া। ১৩ সপ্তাহ ধরে চলছে তাদের এ কার্যক্রম। আর ছিন্নমূল মানুষকে খাওয়ানোর এই কাজে আর্থিক সহযোগিতা কখনো নিজেরা, কখনো অন্যের মাধ্যমে জোগাড় করছেন সংগঠনটির সদস্যরা।

একই কার্যক্রম ঢাকার বাইরে উত্তরবঙ্গের দুটি জেলায় চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। জেলা দুটি হলো, নওগাঁ ও পঞ্চগড়। ঢাকার মতো সেখানেও প্রতি শুক্রবার একই পদের খিচুড়ি ও গরুর মাংস রান্না হয়। নামাজের পর শুরু হয় মেহমানদারি। এ দুই জেলায় মোট ৩০০ অসহায় ও পথচারী খান।

সরেজমিনে শুক্রবার বনশ্রীর ই-ব্লকের ৮ নম্বর রোডের জোহা টাওয়ারের সামনে মেহমানখানায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৪ শতাধিক শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী অসহায় মানুষ সারিবদ্ধভাবে বসে গরুর মাংস আর খিচুড়ি খেতে ব্যস্ত। অনেক নারী-পুরুষ দুই তিন দফায় নিচ্ছেন খিচুড়ি-মাংস। সব মিলে মনে হলো এ এক মহামিলন মেলা।

বনশ্রীর এ মেহমানখানায় খেতে আসা ৬৭ বছর বয়সী সোবহান আলীর সঙ্গে কথা হয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাজ করতে পারেন না তিনি। তাই ভিক্ষায় নেমেছেন।

তিনি জানান, ভিক্ষা করতে গিয়ে অনেকের কাছে আগে খাবার চাইতে হতো। অনেকে ফিরিয়ে দিতেন। কেউ কেউ খাবারও দিতেন। তবে কোথায়, কখন খাবার জুটবে সেটা ছিল অনিশ্চিত। দীর্ঘদিন পর তিনি খাবারের জন্য নিশ্চিত একটা ঠিকানা পেয়েছেন বলে জানালেন।

সোবহান আলী বলেন, জুমার নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই এখানে চলে আসি। খাবার নিয়ে হুড়োহুড়ি করতে হয় না। সবাই যার যার মতো বসে পড়ি। তারাই খাবার সামনে এনে দেন। তিন শুক্রবার হলো এখানে খাচ্ছি। রান্নাও ভালো। খাবারও বেশি দেন। যারা খাওয়াচ্ছেন তারা সবাই ভালো মানুষ। আল্লাহ তাদের ভালো করবেন।

সোবহান আলীর সঙ্গে কথা বলার সময় পাশ থেকে তাল মেলালেন ৫৬ বছর বয়সী ফরিদা খাতুন। স্বামীর মৃত্যুর পর অনিশ্চিত হয়ে যায় তার জীবন সংগ্রাম। পরিবারে আয়ের কেউ না থাকায় তিনিও নেমেছেন ভিক্ষায়।

ফরিদা বলেন, শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকি। মনে হয় কেউ যেন একজন দাওয়াত দিয়ে রেখেছেন। সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়ার মজাই আলাদা। খাবারের স্বাদ খুব ভালো। গরুর মাংসও অনেকটা দেয়। এখানে প্রতি সপ্তাহে গরুর মাংস খাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। কেনার তো সামর্থ্য নেই।  
 
সেখানে কথা হয় স্বেচাসেবী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী তাজুল ইসলাম বাপ্পি, তৌসিফ তুষার, সাইদুল ইসলাম লিপু ও সংগঠনটির কোষাধ্যক্ষ ব্যবসায়ী মাহবুবুল হাসান শুভর সঙ্গে।

সবাই জানালেন, কাউকে খাওয়ানোর মাঝে যে এত তৃপ্তি সেটা আগে জানতাম না। প্রতি শুক্রবার যখন দেখি অসহায় এসব ছিন্নমূল মানুষ খুব মজা করে খাবার খাচ্ছেন, তখন শান্তি লাগে। আমরা এর পরিধি আরো বাড়াব।

এ প্রসঙ্গে বনশ্রীর মেহমানখানা ও সিটিজেন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (সিডিএফ) সভাপতি আসিফ ইকবাল প্রিন্স ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। আমরা অনেকেই শুক্রবার বাড়িতে পরিবার নিয়ে ভালো-মন্দ খাওয়ার আয়োজন করি। কিন্তু এসব মানুষ সেটা পারেন না। তাদের অসহায় জীবনযাপনের বিষয়গুলো চিন্তা করেই আমরা এ উদ্যোগ নিয়েছি।

তিনি বলেন, প্রতি শুক্রবার ঢাকাসহ দুই জেলায় এসব মানুষকে খাওয়াতে প্রায় ৩৮ হাজার টাকা খরচ হয়। এই টাকা আমরা দেশ-বিদেশ থেকে সহযোগিতা হিসেবে পাই। আমাদের এ উদ্যোগের কথা জেনে অনেকেই নিজ থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। সামনে ইচ্ছে আছে আয়োজন আরো বড় করার।

এমএএস