‘একান কার্ডের জনতে আর কার কাছে যাইম’
অশীতিপর বৃদ্ধা অবিরন বেগম
‘মোর কপাল খারাপ। ভোট আসলে সবায় আশা দেয়। কিন্তু পরে আর কায়ো খোঁজ নেয় না। মুইও আর কারও দেকা পাওনা। এই বুড়া বয়সোত কত জনের কাছে গেনু। সবায় খালি কয় হইবে। কিন্তু আইজো কার্ড পানু না। একান কার্ডের জনতে আর কার কাছে যাইম? মুই কি ভাতা পাবার নাও।’ এভাবেই মনের জমানো দুঃখ আর আক্ষেপ থেকে কথাগুলো বলছিলেন অশীতিপর বৃদ্ধা অবিরন বেগম।
অভাব-অনটনের সংসারে স্বামী-সন্তান কিছুই নেই তার। ২০ বছর আগে দুরারোগ্য ব্যাধি মারা গেছেন স্বামী। দুই ছেলে আর এক মেয়ের জননী অবিরন। কিন্তু তার তিন সন্তানই প্রতিবন্ধী। এদের মধ্যে ছোট ছেলে বেঁচে নেই। মেয়ের বিয়ে হয়েছে এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আধ পাগলের সাথে। তারা নিজেদেরও খাবার জোটাতে পারে না। আরেক প্রতিবন্ধী ছেলে ঢাকার পথে পথে ভিক্ষা করছে। এ অবস্থায় ১০ বছর ধরে একাই অসহায় জীবনযাপন করছেন ৮৩ বছর বয়সী অবিরন বেগম।
বিজ্ঞাপন
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তাম্বুলপুর গ্রামে অবিরন বেগমের বসবাস। একটি জরাজীর্ণ ঘরে কোনো রকমে জীবনের শেষ সময় কাটাচ্ছেন তিনি। স্বামী-সন্তানহীন সংসারে অন্যের সাহায্য সহযোগিতার ছাড়া অচল অবিরন। কারও দয়া বা সহানুভুতি ছাড়া তিন বেলা ঠিক মতো ভালো খাবার জোটে না। তাই সরকারি যে কোনো ভাতা (বিধবা ভাতা/বয়স্ক ভাতা) চাই তার।
অবিরন বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মুই বুড়ি দেকি কি মোর টাকার দরকার নাই। অসুখ হইলে টাকা ব্যাগড়ে (না থাকায়) ভালো ওষুধ খাবার পাও না। তিন বেলা একনা ভালো খাবার পাওনা। সরকার মাইনসোক কত কিছু দেওছে। কিন্তুক মোর বেলায় আসি মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছোত কিছুই থাকে না। যে কোনো সময় মরি যাইম, তাও মনে হয় মুই বয়স্ক ভাতার কার্ড পাবার নাও। মোক একান কার্ড করি দেলে মরার আগোত একনা সুখে থাকিম।’
বিজ্ঞাপন
অভাবের সংসারে এক প্রতিবন্ধী ছেলে ঢাকায় ভিক্ষা করে পেট চালান। মাঝে মধ্যে সেই ছেলে ঢাকা থেকে টাকা পাঠালেও তা খুবই সামান্য। যা দিয়ে মাসও যায় না। এজন্য অবিরন একটা বয়স্ক ভাতার কার্ড পেতে বিভিন্নজনের কাছে গিয়েছেন।। কিন্তু তার ভাগ্যে জোটেনি বয়স্ক ভাতা বা বিধবা ভাতার সেই কার্ড। এমনকি করোনার দুর্দিনেও সরকারি সাহায্য সহযোগিতা থেকে এই বৃদ্ধা বঞ্চিত ছিলেন।
আর কত বছর বয়স হলে চেয়ারম্যান-মেম্বার ভাতার কার্ড করে দিবেন- এ প্রশ্ন রেখে অবিরন বলেন, ‘মুই বুড়ি মানুষ। খুবই অসহায়। মোর কায়ো নাই। অনেক আগোম স্বামী মরছে। দুইটা ব্যাটার একটা মরছে, আর একটা ঢাকাত ভিক্ষা করে। বেটি কোনার বিয়্যাও দিচু, কিন্তু উয়ারো কপাল খারাপ। মুই এই বয়সোত একলায় একলায় বাড়িত থাকো। কষ্ট করি মেম্বার-চেয়ারম্যান সবাক অনুরোধ করিচু, মোক একান কার্ড করি দেও। খালি কয় পাইমেন, কিন্তু পাইম কিনা তাও জানো না।’
এ ব্যাপারে তাম্বুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য সাদেক হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেকেই তো কার্ড পেয়েছে। যারা বয়স্ক তাদের সবাইকে সরকারি সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। যারা আমার কাছে এসেছে, আমি তাদেরকে নিয়ম অনুযায়ী অনলাইনে আবেদন করতে বলেছি। অনেকেই করেছেন, অনেকে ঝামেলা মনে করে আবেদন করেননি। এজন্য অনেক বৃদ্ধার বয়স্ক ভাতার কার্ড পাওয়ার কথা থাকলেও পায়নি। তবে অবিরন বেগম যদি কার্ড না পেয়ে থাকেন, তার জন্য আমি চেষ্টা করব।
অন্যদিকে তাম্বুলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রওশন জমির রবু সর্দারের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, যারা কার্ড পায়নি, তাদেরকে আবেদন করতে বলা হয়েছে। ইউনিয়নে তো অনেক মানুষ। কে কার্ড পেয়েছি আর কে পাইনি, তারও খোঁজ নেয়া হচ্ছে। যদি ওই বৃদ্ধার সুযোগ থাকে তাহলে ব্যবস্থা করা হবে।
এ বিষয়ে পীরগাছা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এনামুল হক বলেন, এতো বয়স্ক লোক বয়স্ক ভাতার আওতায় পড়েননি, এটা আমার জানা ছিল না। যত দ্রত সম্ভব অবিরন বেগমের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব। কারণ বয়স হিসেবে তো তার বয়স্ক ভাতার কার্ড পাওয়ার কথা। কিন্তু এতো দিনে কেন হয়নি, তা বোধগম্য নয়।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর