উত্তরের জেলা পাবনায় শীতের প্রকোপ বাড়ছে। গত কয়েক দিন ধরে জেলার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শীতের প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত নানা রোগ। প্রতিদিন শিশু ও বৃদ্ধসহ অর্ধশতাধিক মানুষ শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ২৫০ শয্যার পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।

হাসপাতালের শিশু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে বর্তমানে ২১০ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। শয্যা না পেয়ে হাসপাতালের বারান্দা ও করিডোরে অবস্থান করতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের। 

সরেজমিনে শনিবার (১৫ জানুয়ারি) বিকেলে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, পাবনা জেনারেল হাসপাতালেই প্রতিদিন নিউমোনিয়াসহ ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ৬০-৭০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। শয্যা না থাকায় অধিকাংশ রোগীর জায়গা হয়েছে বারান্দা অথবা করিডোরে। ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগী আসায় তাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের। রোগীরা এক সপ্তাহ ধরে হাসাপাতালে ভর্তি থাকলেও তাদের জন্য শয্যা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জরুরি বিভাগেও রোগীর বাড়তি চাপ দেখা গেছে। শিশু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ছোট্ট তিনটি রুমে শতশত মানুষ গাদাগাদি করে অবস্থান করছেন। করোনা সংক্রমণ রোধে কাউকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর শীতের মৌসুমে জেলায় অল্প সংখ্যক শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধরে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ থাকায় শীতে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডে ৩৬টি শয্যা থাকলেও এখানে রোগী ভর্তি রয়েছে ১৪০ জন। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১৬টি শয্যার বিপরীতে ৭০ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। 

বেশিরভাগ রোগী হাসপাতালের বারান্দায় বা করিডোরে অবস্থান করছেন। গত ১০ দিন যাবত রোগীর চাপ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। জরুরি বিভাগেও প্রতিদিন অন্তত শতাধিক রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন।

পাবনা জেনারেল হাসপাতালের পরিসংখ্যান কর্মকর্তা সোহেল রানা ঢাকা পোস্টকে জানান, হাসপাতালে প্রতিদিন নিউমোনিয়াসহ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে গড়ে ৫০-৬০ জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এদের বেশিরভাগই শিশু ও বৃদ্ধ। 

তিনি বলেন, শনিবার (১৫ জানুযারি) দুপুর পর্যন্ত শিশু ওয়ার্ডে ১৪০ জন ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৭০ জন রোগী ভর্তি আছেন। পাবনা জেনারেল হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ২৫০টি। এর মধ্যে করোনা রোগীদের জন্য ১০০ শয্যা সংরক্ষিত করে রাখার পর বাকি রয়েছে ১৫০টি শয্যা। কিন্তু এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি রয়েছেন গড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ জন। শিশু ওয়ার্ডের ১৫ জন নার্স ও পাঁচজন চিকিৎসক দুই শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন। 

গত ১৫ দিনে শিশু ওয়ার্ডে ৮২০ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগী প্রায় ৩ শতাধিক, ডায়রিয়া আক্রান্ত শতাধিক। বাকি সবাই জ্বর, থ্যালাসেমিয়া, খিচুনিসহ নানা রোগে আক্রান্ত।  

ঈশ্বদীর দাশুড়িয়া লক্ষ্মীখোল গ্রাম থেকে আসা শিশু ইউসুফ আলীর মা রোজিনা খাতুন বলেন, হঠাৎ করেই গত কয়েকদিন থেকে আমার ছেলেটি অপুষ্টিজনিত কারণে ভুগছিল। চিকিৎসকের পরামর্শে পাঁচদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করার পর জানা গেল শিশুর নিউমোনিয়া হয়েছে। এত মানুষের চাপ আর সহ্য হচ্ছে না। ভালো মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ছি।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শহরের নয়নামতি গ্রামের শিশু রায়হান আলীর মা রুমি আক্তার বলেন, ৬ দিন আগে শিশুর ঠান্ডা-জ্বর দেখা দেয়। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে জ্বর কমেনি। হাসপাতালে ভর্তি করার পর ডায়রিয়াও দেখা দিয়েছে। পরীক্ষা করে নিউমোনিয়া শনাক্ত হয়েছে। তার চিকিৎসা চলছে। 

ঈশ্বরদীর রূপপুর থেকে আসা শিশু রায়হানের মা সিমা খাতুন বলেন, আজ সাত দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি হলেও এখন পর্যন্ত সিট জোটেনি। বাধ্য হয়েই হাসপাতালের বারান্দায় অবস্থান করছি। বারান্দায় রাতযাপন করায় প্রচন্ড শীত ও কুয়াশার কারণে ছেলের ঠান্ডা কমছে না। সঙ্গে প্রচুর মশার যন্ত্রণায়ও রাত কাটাতে হয়। সব মিলিয়ে নানা অসুবিধার মধ্যে হাসপাতালে অবস্থান করছি। 

পাবনা জেনারেল হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স মিতা খাতুন ও ডায়রিয়া ওয়ার্ডের সিনিয়র স্টাফ নার্স আসমাউল হুসনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাতে শীত ও দিনে বাতাস থাকায় প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ছে। এতে হাসপাতালে শিশু ও বৃদ্ধ রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসক সংকটের জন্য সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জনবল সংকট হলেও মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণ স্যালাইন ও ওষুধ মজুদ আছে।

পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. কে এম আবু জাফর ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপে কোনো ওয়ার্ডেই নির্ধারিত শয্যা অনুযায়ী রোগী ভর্তি বা চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না। তারপরও আমরা এই সীমিত ব্যবস্থার মধ্যে রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসকের ২০টি পদ শূন্য রয়েছে। হাসপাতালে বেড সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। 

এদিকে জেলা সদর ছাড়াও জেলার অন্য আটটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও ঠান্ডাজনিত রোগে শিশু, বয়স্কসহ নানা বয়সী মানুষ ভর্তি হচ্ছেন। আটটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গত এক সপ্তাহে অন্তত ৫ শতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন। 

পাবনার সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাবনায় শীতজনিত রোগ বাড়লেও চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। আতঙ্কিত হওয়ার মতো এখনো কিছু হয়নি। প্রতি বছর এ সময় ঠান্ডাজনিত কারণে নানা অসুখে শিশু ও বৃদ্ধসহ অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে। রোগীর সংখ্যা যদিও বেড়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। করোনা প্রতিরোধে আমরা রোগীসহ চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছি। হাসপাতালে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। 

রাকিব হাসনাত/আরএআর