সুনামগঞ্জে তৈরি হচ্ছে ৩ সাংস্কৃতিককেন্দ্র, নাম নেই হাছন রাজার
সুনামগঞ্জে তিন মনীষীর নামে হচ্ছে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, জ্ঞানের সাগর দূর্বিণ শাহ ও বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের নিজ জন্মস্থানে হবে এসব সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সেখানে তাদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে চর্চা হবে। তবে মরমি কবি হাছন রাজার নামে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। তারা বলছেন, হাছন রাজার সৃষ্টিকর্ম প্রসারে তার নামে সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণ জরুরি।
মরমি কবি হাছন রাজার গানের বিচিত্রতা লক্ষ্যণীয়। তিনি লিখেছেন জাগতিক, আধ্যাত্মিক, জগৎ সংসার নিয়ে প্রেমের গান। তিনি গানে গানে বলেছেন, এই পৃথিবীতে মানুষের আগমন একটা স্বল্প সময়ের জন্য, এখানে কেউই চিরস্থায়ী নয়। মানবিকতাবোধকে তিনি উচ্চ স্তরে স্থান দিয়েছেন যেখানে মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সংহতি এবং সহনশীলতাবোধের গভীর দিকদর্শন রয়েছে, রয়েছে অসাম্প্রদায়িকতার কথাও।
বিজ্ঞাপন
তিনি যেমন ছিলেন বিখ্যাত জমিদার তেমনই ছিলেন সুরের সাধকও। নিজের সৃষ্টিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দাঁড় করিয়ে গেছেন। লক্ষণশ্রীর ধনাঢ্য জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়া হাছন রাজার গানে সহজ-সরল ভাষায় মানবতার চিরন্তন বাণী উচ্চারিত হয়েছিল। সব ধর্মের বিভেদ অতিক্রম করে তিনি গেয়েছেন মাটি ও মানুষের গান।
সম্প্রতি সারাদেশের ২১ জন মনীষীর নামে সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়। এই ২১ জন মনীষীর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলার তিনজনের নাম রয়েছে। বৈষ্ণব সাধক রাধারমণ দত্ত, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম এবং জ্ঞানের সাগর দূর্বিণ শাহ।
বিজ্ঞাপন
দীর্ঘ দিন ধরে সুনামগঞ্জের চার বাউল সাধকের নামে সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণের দাবি ছিল সুনামগঞ্জবাসীর যেখানে বাউলদের জীবনকর্ম, সৃষ্টিচর্চা ও গবেষণা হবে। সম্প্রতি জেলা শিল্পকলা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, জেলার তিন বাউল সাধকের নামে তাদের নিজ এলাকায় সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। হাছন রাজা বাদ পড়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন জেলার সংস্কৃতিকর্মীরা।
তারা বলছেন, নব্বইয়ের দশকেও হাছন রাজার মাধ্যমে দেশসহ সারাবিশ্বে সুনামগঞ্জ পরিচিত পেয়েছে। সেখানে এখন হাছন রাজার চর্চা কমে যাচ্ছে এর প্রধান কারণ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাব। আর তাই তিনজনের নামে সাংস্কৃতিককেন্দ্র নিমার্ণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাদ পড়ে গেছেন মরমি সাধক হাছন রাজা।
জেলা শিল্পকলা একাডেমি সূত্রে জানা যায়, বর্তমান শিল্পকলা একাডেমির নতুন ভবন নির্মাণ প্রকল্পটি হাছন রাজা শিল্পকলা একাডেমি নামে অনুমোদন ও বাস্তবায়ন হয়েছে। অংসখ্য বাউলের জেলায় শিল্পকলা একাডেমির ভবন একজনের নামে হওয়ায় এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়। পরে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মিটিংয়ে হাছন রাজা শিল্পকলা একাডেমি নামটি পরিবর্তন করে জেলা শিল্পকলা একাডেমি নামে নামকরণ করা হয়। যেহেতু আগে হাছন রাজার নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে তাই নতুন করে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে হাছন রাজার নামে সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
রঙ্গালয় থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, সুনামগঞ্জ মানেই হাছন রাজা। হাছন রাজাকে বাদ দিয়ে সুনামগঞ্জের কথা চিন্তা করা যায় না। নব্বইয়ের দশকেও বাইরে কোথাও গেলে হাছন রাজার কথা বললেই মানুষ সুনামগঞ্জকে চিনেছে। সে জায়গায় তিন জন মনীষীর সঙ্গে হাছন রাজার নামেও সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণের উদ্যাগ নেওয়া হোক।
সুর নিকেতন পরিচালক পল্লব ভট্টাচার্য্য বলেন, সারা বাংলাদেশে ২১ জন মনীষীর নামে সংস্কৃতিককেন্দ্র করা হচ্ছে। এটা খুবই গর্বের বিষয়। সে জায়গায় আমাদের সুনামগঞ্জেরও তিনজন মনীষী রয়েছেন। তবে আমরা যারা সংস্কৃতিপ্রেমী, সংস্কৃতি চর্চা করি তাদেরও দাবি তিনজনের সঙ্গে হাছন রাজার নাম যুক্ত করে সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণ করা হোক।
থিয়েটার সুনামগঞ্জের দলপ্রধান দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী বলেন, মরমি কবি হাছন রাজাকে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের মানুষ তার কর্মের জন্য চেনেন। আগে হাছন রাজার নামে শিল্পকলা একাডেমির নামকরণের কথা ছিল, কিন্তু পরে এটাকে শিল্পকলা একাডেমি করা হয়েছে। এখন সারা জেলায় মনীষীদের নামে সাংস্কৃতিককেন্দ্র করা হচ্ছে। কিন্তু জেলায় উনার নামে কোনো একাডেমি নেই।
তিনি আরও বলেন, আমরা জানি না হাছন রাজাকে বাদ দিয়ে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় কেন এই উদ্যোগ নিয়েছে। হাছন রাজার মতো মরমি সাধকদের সৃষ্টিকর্ম এমনিতেই কমে যাচ্ছে। সরকার যদি নিজে উদ্যোগ না নেয় তাহলে এক দিন আমাদের মরমি সাধকরা হয়তো হারিয়ে যাবে।
হাছন রাজা ট্রাস্টের সভাপতি দেওয়ান ইমদাদ রেজা চৌধুরী বলেন, সুনামগঞ্জ হাছন রাজাকে দিয়েই পরিচিত। বাইরের লোককে হাছন রাজার পরিচয় দিয়েই নিজের পরিচয় দিতে হয়। কিন্তু বারবার হাছন রাজা একাডেমির দাবি জানালেও এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। সুনামগঞ্জবাসীর দাবি, হাছন রাজার নামেও সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণ করা হোক।
জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী বলেন, জেলা শিল্পকলা একাডেমির নতুন ভবনের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে হাছন রাজা শিল্পকলা একাডেমি হিসেবে। পরে জেলা উন্নয়ন কমিটির সমন্বয় সভায় সর্বসম্মতিক্রমে হাছন রাজার নাম বাদ দেওয়া হয়। এজন্য নতুন করে সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে অন্যান্য বাউল সাধকদের মতো হাছন রাজাকেও মূল্যায়িত করে হাছন রাজা সাংস্কৃতিককেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এসপি