ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ ৩ তরুণের পরিবারে উৎকণ্ঠা
দালালদের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয় ফরিদপুরের নগরকান্দার কাইচাইল ইউনিয়নের তিন তরুণ। তাদের সন্ধান পেতে উদগ্রীব পরিবারের সদস্যরা। তারা জানেন না তাদের সন্তানরা বেঁচে আছে কি না।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ২৭ জানুয়ারি লিবিয়ার ত্রিপুল শহর থেকে ইতালি যাওয়ার পথে জাহাজে ভূমধ্যসাগর পার হওয়ার সময় নিখোঁজ হয় ওই তিন তরুণ। ১৩ দিন পার হলেও পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি তারা। তারা বেঁচে আছে নাকি সাগরে জাহাজ ডুবে মারা গেছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত নয় পরিবারের সদস্যরা।
বিজ্ঞাপন
নিখোঁজ তিন তরুণ হলেন- বাবুর কাইচাইল গ্রামের বাসিন্দা ছয় নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফারুক মাতুব্বরের ছেলে ফয়সাল মাতুব্বর (১৯), মাজেদ মিয়ার ছেলে নাজমুল মিয়া (২২) এবং দক্ষিণ কাইচাইল গ্রামের ইউনুস শেখের ছেলে সামিউল শেখ (২১)।
সামিউলের মা সালমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার সোনা পাখির (ছেলের) যে বিপদ হবে তা আমি সেদিনের (২৭ জানুয়ারি) কথায় বুঝছিলাম। শেষ কথা হইলো ২৭ তারিখ রাত ১০টায়। সেদিন ও আমারে কইলো মা সাগরপাড়ে আনছে আমাগো। এখন নাকি মোবাইল নিয়া যাবে মা। আমার কেমন যেন লাগতেছে। আমার জন্য দোয়া কইরো মা। বাঁইচা থাকলে আবার কথা কব মোবাইলে। আমার বাজান তো আর এখন মোবাইলে কথা কয় না। আমার বাজান কী বাঁইচা নাই? যদি জানতে পারতাম আমার বাজান বাঁইচা আছে তাইলে আর কিছুই চাইতাম না।
বিজ্ঞাপন
সামিউলের বাবা ইউনুস শেখ বলেন, দালালরা প্রথমে আমার ছেলের মাথায় বিদেশ যাওয়ার ভূত ঢুকাইছে। বিপদ জাইনাও টাকা গুছাই দিতে বাধ্য হইছি। আইজ ১৩ দিন হইলো ছেলের কোনো খোঁজ নাই। বিদেশের দালাল মোবাইল ধরে না। দেশের দালাল ঘরবাড়ি তালা দিয়া পলাইছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা সব টাকার লেনদেন করছি ইউপি সদস্য ফারুক মাতুব্বরের বাড়িতে। তার ছেলেও নিখোঁজ। ফারুক মাতুব্বরও এখন কিছু বলতে পারছেন না। লিবিয়ার দুই দালাল শওকত ও রাসেল তার (ফারুক মাতুব্বরের) মামাতো ভাইয়ের ছেলে। সেই ভরসায় আমরা টাকা দিছিলাম।
এসব বিষয় স্বীকার করেন ফয়সাল মাতুব্বরের বাবা ইউপি সদস্য ও কাইচাইল ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক মাতুব্বর। তিনি বলেন, লিবিয়ায় অবস্থানকারী দুই দালাল আমার মামাতো ভাইয়ের ছেলে। সেই ভরসাতেই আমার ছেলেসহ দুইজনের টাকা আমার বাড়িতে আমার হাত দিয়েই গুণে দিয়েছি। আমার নিজের ছেলেও নিখোঁজ।
বাবুর কাইচাইল গ্রামের মাজেদ মিয়া ও রেখা বেগমের ছেলে নাজমুল মিয়া (২২)। তিন ভাইয়ের মধ্যে সে দ্বিতীয়। নাজমুলের মা ছেলের নিখোঁজ হওয়ার খবরে দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কোনো কথা বলছেন না। শুধু বাড়ির এ ঘর থেকে ও ঘরে আঁচলে মুখ লুকিয়ে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছেন।
বাবুর কাইচাইল গ্রামের বাসিন্দা ছয় নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফারুক মাতুব্বরের ছেলে ফয়সাল মাতুব্বর (১৯)। মা মনোয়ারা বেগম (৫৮) গৃহিণী। চার ভাইয়ের মধ্যে মেঝ ফয়সাল। ফয়সাল মাতুব্বরের মা মনোয়ারা বেগম ছেলের চিন্তায় শয্যাশায়ী।
মনোয়ারা বেগমের স্বামী ফারুক মাতুব্বর জানান, ছেলের দুশ্চিন্তায় স্ত্রীর শরীর অসুস্থ। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। গ্রাম্য চিকিৎসকের মাধ্যমে শরীরে দেওয়া হয়েছে চারটি স্যালাইন।
নিখোঁজ ওই তিন তরুণের পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১৪ নভেম্বর নৌপথে সমুদ্র পার হয়ে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য ছোট নাওডুবি গ্রামের হান্নান মাতুব্বরের ছেলে শাহিন মাতুব্বর (৪১) ও মৃত শামসুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে ইলিয়াস মাতুব্বরের (৩৯) সঙ্গে ঢাকা যায় তিন তরুণ। ঢাকার কাকলী মোড় এলাকার একটি হোটেলে তিন দিন থাকেন। সেখান থেকে ১৭ নভেম্বর লিবিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৮ নভেম্বর লিবিয়া পৌঁছান।
ওখান থেকে প্রায় সোয়া দুই মাস পর ২৭ ডিসেম্বর ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে জাহাজে করে রওনা দেন। লিবিয়া হয়ে ইতালি নেওয়ার জন্য এই দুই দালাল তিন তরুণের প্রত্যেকের বাড়ি থেকে সাত লাখ ৬০ হাজার করে টাকা নেন। চুক্তি ছিল ১০ লাখ করে টাকা নেবেন। বাকি ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ইতালি পৌঁছানোর পর দেওয়ার কথা ছিল।
এই দালাল চক্রের দুই সদস্য থাকেন লিবিয়া। তারা হলেন- একই গ্রামের (ছোট নাওডুবি) মৃত শামছুদ্দিন মাতুব্বরের ছেলে শওকত মাতুব্বর (২৫) ও চানু মাতুব্বরের ছেলে রাসেল মাতুব্বর (৩৫)।
ছোট নাওডুবি গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এই দুই দালাল চার বছর ধরে লিবিয়া আছেন। চার বছরে তারা একই পদ্ধতিতে স্থানীয় দুই তরুণসহ আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার ৮-৯ জনকে ইতালি নিয়েছেন।
ছোট নাওডুবি গ্রামের বাসিন্দা লিবিয়ায় অবস্থানকারী দালাল রাসেলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে তিনটা ঘর। যার দুইটি সেমি পাকা ও একটি টপ বারান্দা (বারান্দা পাকা)। প্রতিটি ঘর তালাবদ্ধ।
ওই এলাকার বাসিন্দারা জানায়, গত ২৯ জানুয়ারি ভোর রাতে একটি ট্রাকে করে ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র ও চারটি গরু নিয়ে পালিয়ে গেছেন পরিবারের সদস্যরা।
দালাল শাহিন মাতব্বরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তার দুইতলা ভবনের বাড়িটি বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করা রয়েছে। বাড়িতে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।
এ ঘটনায় নিখোঁজ ফয়সালের বাবা ফারুক মাতুব্বর বাদী হয়ে শনিবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) ১০ জনকে আসামি করে মানবপাচার আইনে একটি মামলা করেন নগরকান্দা থানায়।
এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগরকান্দা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) পীযূষ কান্তি দে বলেন, এ মামলার দুই আসামি হান্নান মাতুব্বর এবং তার ছেলে তুহিন মাতুব্বরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।
নগরকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাবিল হোসেন বলেন, এ মামলার এজাহারভুক্ত ১০ আসামির মধ্যে দুইজনকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অন্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
জহির হোসেন/এসপি