বগুড়া শহরের ফুলবাড়িতে নূর মোহাম্মদের ইউনিসন হারবাল অ্যান্ড নিউট্রাসিউটিক্যাল ভবন

বগুড়ায় হোমিও, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার আড়ালে চলছে অবৈধ দেশীয় চোলাই মদ, রেক্টিফাইড স্পিরিট বা ইথাইল অ্যালকোহলের রমরমা ব্যবসা। যা সরবরাহে রয়েছে নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক দালাল, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা। এলাকার কিছু মধ্যবয়সী ব্যক্তি ও রিকশাচালকরা সাপ্তাহিক বা মাসিক চুক্তিতে এসব সরবরাহের দায়িত্ব রয়েছেন। খুচরায় প্রকৃত দামের চেয়ে ৪-৫ গুন বেশি দামে তা বিক্রি করা হয় মাদকসেবীদের কাছে। আবার চাহিদা মাফিক পৌঁছে দেয়া হয় স্থায়ী ক্রেতাদের কাছে।

ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পানি মিশিয়ে রেক্টিফাইড স্পিরিট তৈরি করা হয়। আর এই রেক্টিফাইড স্পিরিটের ব্যবসা করে রাতারাতি অনেকে কোটিপতি বনে গেছেন। ভেজাল মদ সরবরাহে মৃত্যুর মত ঘটনা ঘটলেও শাস্তি হয়নি কারও।

হোমিও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রায় তিন দশক ধরে বগুড়াসহ উত্তরবঙ্গের বেশির ভাগ হোমিও ল্যাবরেটরিতে রেক্টিফাইড স্পিরিট সরবরাহ করেছেন পারুল হোমিও ল্যাবরেটরি হলের তৎকালীন কর্ণধার নূর মোহাম্মাদ (৬৫)। তবে সেটি এখন তার ভাই নুর নবী (৫৮) পরিচালনা করেন। আরেক ভাই নুরে আলম (৫৮) পুনম হোমিও ল্যাবরেটরি পরিচালনা করেন। হোমিও হলের নামে দুটি ল্যাবরেটরি থাকলেও একটি ল্যাবরেটরিতে চলে দুই ভাইয়ের মহাযজ্ঞ। নূর মোহাম্মাদ বর্তমানে ‘ইউনিসন হারবাল এন্ড নিউট্রাসিউটিক্যাল’ নামে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।

নূর মোহাম্মাদকে ২০০৭ সালে জানুয়ারি মাসে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ৩৬ বোতল অ্যালকোহলসহ গ্রেপ্তার করে। পরে জেল থেকে বের হয়ে বগুড়া থেকে ঢাকায় গিয়ে অবস্থান নেন তিনি। সেখানে শুরু হয় তার নতুন করে ইউনিসন হোমিও হলের যাত্রা। সেখান থেকে এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। 

পারুল হোমিও হলের সাবেক এক কর্মচারী জানান, ২০০৭ সালে র‌্যাব সদস্যরা নূর মোহাম্মাদকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আতঙ্কে চাকরি ছেড়ে এখন তিনি বিভিন্ন ধরনের কাঁচামালের ব্যবসা করেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকায় গিয়ে নতুন করে আবার পারুল হোমিও হলের যাত্রা শুরু করেন নূর মোহাম্মাদ। এতে যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান। এক যুগেই নূর মোহাম্মাদ বনে গেছেন কোটিপতি। বছরের বেশির ভাগ সময় এখন দেশের বাইরে থাকেন। 

ফুলবাড়িতে পুনম হোমিও হল ও পারুল হোমিও হলের ল্যাবরেটরি ভবন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশির দশকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের রাজনীতি দিয়ে নূর মোহাম্মাদের উত্থান শুরু। সে সময় ১৯৮৭ সালে বাম ছাত্রনেতা লাকী হত্যা মামলার জেলা বিএনপির সাবেক দুই সভাপতির সাথে নূর মোহাম্মাদও আসামি ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে তিনি মায়ের নামে মাদকের লাইসেন্স নিয়ে যাত্রা শুরু করেন ‘পারুল’ হোমিও হলের। সে সময় পঞ্চগড়ের মার্শাল ডিস্ট্রিলারিজের উৎপাদিত রেক্টিফাইড স্পিরিটের উত্তরবঙ্গের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল নূর মোহাম্মাদের। ১৯৯৮ সালে গাইবান্ধা জেলায় রিপা হোমিও হলের বিক্রি করা বিষাক্ত মদ পানে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। বাংলা নববর্ষের উৎসব ঘিরে এ ঘটনা ঘটে।

পরে পুলিশি তদন্তে জানা যায়, রিপা হোমিও হল থেকে বিক্রি করা বিষাক্ত মদের সরবরাহকারী ছিল বগুড়ার পারুল হোমিও হল। সে সময় রিপা হোমিও হলের মালিক রবীন্দ্রনাথ সরকারের নামে মামলা হয়। ওই মামলায় ২০০২ সালে তার ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। তবে রায় ঘোষণার আগেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান রবীন্দ্রনাথ সরকার। 

এরপর ২০০০ সালে বিষাক্ত মদ পানে বগুড়ায় ২২ জন মারা যান। এ ঘটনা তদন্তে পারুল হোমিও হলের তৎকালীন মালিক নূর মোহাম্মাদের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ। কিন্তু বিএনপির তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের লোক হওয়ায় সেবারও পার পেয়ে যান তিনি। ২০০৭ সালে র‌্যাব সদস্যরা অভিযান চালিয়ে নূর মোহাম্মাদকে গ্রেপ্তার করে। সে সময় নূর মোহাম্মাদের কাছে ৩৬ বোতল অ্যালকোহল পান র‌্যাব সদস্যরা। কিছু দিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বগুড়া থেকে ঢাকায় চলে যান নূর মোহাম্মাদ। তারপর থেকে তাকে আর খুব একটা এলাকায় দেখা যায়নি।

গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বগুড়ায় বিষাক্ত মদপানে ১৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ বলছে-  ময়নাতদন্তে বিষাক্ত মদপানে আটজনের মৃত্যুর আলামত পাওয়া গেছে। এ ঘটনার তীরও যায় নূর মোহাম্মাদ, নুরে আলম ও নুর নবীর দিকে। ঘটনার পরদিন থানায় মামলা করা হয়। মামলায় তারা তিন ভাই ও শহরের তিনমাথা খান হোমিও হলের মালিক শাহীনুর রহমান খানসহ অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়। এ মামলার পর পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করে।

গ্রেপ্তাররা হলেন- পারুল হোমিও ল্যাবরেটরির মালিক নুর নবী, শহরের মুন হোমিও হলের মালিক এমএ খালেক, করতোয়া হোমিও হলের মালিক সাহেদুল আলম ও হাসান হোমিও ফার্মেসির কর্মচারী আবু জুয়েল। এ মামলায় পুনম হোমিও হলের মালিক নূর আলম এখনও পলাতক রয়েছে।

গ্রেপ্তারের পর গত বুধবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে নুর নবীকে নিয়ে পারুল হোমিও ল্যাবরেটরিতে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানে বেশ কিছু কেমিক্যাল ও মদ তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করে পুলিশ। গ্রেপ্তারদের দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বৃহস্পতিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টা থেকে শহরের নাটাইপাড়ায় করতোয়া হোমিও হল ও ল্যাবরেটরিতে অভিযানে যায় পুলিশ। এ সময় সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ ১ হাজার ৫শ লিটার ইথাইল অ্যালকোহল ও বেশ কিছু মেশিন জব্দ করেন। 

গত ১৫ অক্টোবর করতোয়া হোমিও ল্যাবরেটরি সর্বশেষ ২৯ লিটার রেক্টিফাইড স্পিরিট উত্তোলন করেছে। কিন্তু তাদের কাছে এত বিপুল পরিমাণ স্পিরিট কীভাবে এল তা তদন্ত করে দেখছে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

বগুড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, হোমিও চিকিৎসায় অ্যালকোহল সরবরাহে বগুড়ায় ৭টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স রয়েছে। এর মধ্যে শহরের ফুলবাড়ী এলাকার পারুল হোমিও ল্যাবরেটরির নামে দুটি লাইসেন্স রয়েছে। যার একটি বছরে ৩০০ লিটার ও অপরটিকে ১০০ লিটার রেক্টিফাইড স্পিরিট, করতোয়া হোমিও হল বছরে ২৯ লিটার, মাটিডালি এলাকার ফেরদৌস হোমিও হল বছরে ১০ লিটার, লতিফপুর কলোনির নিরাময় হোমিও ফার্মেসি বছরে ২২ লিটার, বেনীপুর হোমিও চেম্বার বছরে ১১ লিটার, দি মুন হোমিও হল বছরে ৫০ লিটার এবং তিনমাথা এলাকার খান হোমিও হলের বছরে ৩০ লিটার স্পিরিট বিক্রির সরকারি অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু এর চিত্র পুরোটাই বিপরীত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বগুড়া শহরে প্রায় ৪ শতাধিক হোমিও ডাক্তার রয়েছেন। যার মধ্যে অর্ধশত ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। এছাড়াও জেলা ও উপজেলায় আরও চার শতাধিক ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসালয় রয়েছে। যেগুলোতে রোগীর সংখ্যা কম হলেও অ্যালকোহলে আসক্ত ব্যক্তিদের আসা-যাওয়া বেশি। বেশির ভাগ হোমিও হলে অবৈধভাবে রেক্টিফাইড স্পিরিট বিক্রি করা হয়। হোমিও চিকিৎসালয় হওয়ায় সহজেই প্রশাসনের নাকের ডগায় অবাধে অবৈধ ব্যবসা করে টাকা কামাচ্ছেন হোমিও হলের নামধারী মালিকরা।

সম্প্রতি বগুড়ায় বিষাক্ত মদ পানে ১৯ জন মারা গেছেন। এদের মধ্যে রিকশাচালক আব্দুল জলিল রয়েছেন। আব্দুল জলিলের ভাগনে জানান, আব্দুল জলিল নিয়মিত দেশীয় মদ পান করতেন। অ্যালকোহলে আসক্ত ছিলেন তিনি। তবে টাকা দিয়ে তিনি মদ কিনতেন না। মাদকসেবীদের জন্য বগুড়া শহরের বিভিন্ন হোমিও হল থেকে অবৈধ অ্যালকোহল নিয়ে এসে সরবরাহ করতেন তিনি। এ কারণে রাতে রিকশা চালাতেন আব্দুল জলিল। তিনি প্রতিদিন হোমিও হলগুলোর দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী অ্যালকোহল পৌঁছে দিতেন। এর জন্য পেতেন ডেলিভারির বিশেষ চার্জ ও ফ্রি মদ।

অপরদিকে মদপানে মৃত্যু হওয়া পলাশের ভাই পায়েল এখন সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। তিনি জানান, ঘটনার দিন রোববার (৩১ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় পারুল হোমিও হল থেকে তারা মদ কিনেন। পরে বাসায় বসে তার ভাই পলাশসহ কয়েকজন তা পান করেন। এতে অসুস্থ হলে পরদিন সোমবার সকালে হাসাপাতালে নেয়া হলে তার ভাই পলাশ মারা যান। তিনি তিনদিন শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাড়ি ফিরেছেন। 

পায়েল আরও জানান, পারুল হোমিও হলের অ্যালকোহল পাইকারি ও খুচরা সরাসরি কারখানা থেকে দেয়া হত। সর্বনিম্ন ৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ যত খুশি কেনা যেত সেখান থেকে। পারুল হোমিও হলের নুর নবী তার নিজস্ব লোক পুষতেন ব্যবসার জন্য। এলাকার দুষ্টু প্রকৃতির লোকদের তিনি ব্যবহার করতেন। কয়েকজন রিকশা চালকও আছে সেই তালিকাতে। যারা শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজন মাফিক অবৈধ রেক্টিফাইড স্পিরিট অর্থাৎ অ্যালকোহল সরবরাহ করেন। 

বগুড়া জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মেহেদী হাসান জানান, অ্যালকোহল বেশি পরিমাণে সেবন করলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু রেক্টিফাইড স্পিরিটের সাথে অন্য কোনো কেমিক্যাল মিশিয়ে করা হলে তা প্রাণঘাতি হয়ে ওঠে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জন্য রেক্টিফাইড স্পিরিট বা ইথাইল অ্যালকোহলের প্রয়োজন হয়। তাই ব্যবসায়ীদের অ্যালকোহলের লাইসেন্স দেয়া হয়। ইথাইল কারখানা পর্যায়ে প্রতি লিটারের দাম ৪৫০টাকা, মিথানল ১২০ টাকা লিটার। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করতে গিয়ে কম দামের মিথানল বা ভিনেচার স্পিরিট ভেজাল দিয়ে মদ বিক্রি করছেন। যা পান করার উপযোগী নয়। 

তিনি আরও বলেন, মিথানল কাঠের বার্নিশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যা প্রাণীর শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

এদিকে বগুড়ায় বিষাক্ত মদপানে মৃত্যুর ঘটনায় আবারও অভিযোগের তীর নূর মোহাম্মাদের দিকে। গত জানুয়ারি মাসে বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। সেখানে নূর মোহাম্মাদ জানান, এক মাস আগে বগুড়ার শিবগঞ্জের ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে নিজ নামে আট বিঘা জমি কিনেছেন তিনি। সেখানে চীনা উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়ে ওয়েস্টেজ প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানে সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের ব্যয় হবে তিনশ কোটি টাকার কাছাকাছি। কিন্তু শিবগঞ্জ উপজেলার সাব রেজিস্ট্রার তার ছাড়পত্র দিচ্ছেন না। 

ওই দিন নূর মোহাম্মাদ জানান, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে হোমিও এবং আয়ুর্বেদিক শিল্পে চীনাদের সাথে তার আরও তিনশ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।

গত শুক্রবার (৫ ফেব্রুয়ারি) বগুড়া শহরের ফুলবাড়ি মধ্যপাড়ায় অবস্থিত পারুল হোমিও ল্যাবরেটরির সামনে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী। মানববন্ধনে এলাকাবাসী ওই হোমিও হলের কারখানা বন্ধের দাবি জানান। মানববন্ধনে মদপানে মারা যাওয়া পলাশের বড় ভাই লাল মিয়া, ছোট ভাই মদ পানে অসুস্থ হওয়া পায়েল, বগুড়া পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর টিপু সুলতান, শাওনসহ আরও অনেকে বক্তব্য দেন। তারা পলাশের মৃত্যুর জন্য নুর নবীকে দায়ী করেন এবং তার ফাঁসি দাবি করে স্লোগান দেন। 

ওই এলাকায় নূর মোহাম্মাদের স্বজনরা জানান, নূর মোহাম্মাদ এখন দেশের বাইরে বেশি থাকেন। গত জানুয়ারি মাসে তিনি এসছিলেন। বর্তমানে দুবাইয়ে বড় মেয়ের বাড়িতে অবস্থান করছেন।

আরএআর