যাদুকাটার জাদুর আড়ালে পাথরখেকোরা
যাদুকাটা নদী (ফাইল ছবি)
সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সুনামগঞ্জের বালু, পাথর মহালে লুটপাটের মহোৎসব চলছে। সবচেয়ে বড় মহাল যাদুকাটার সাত কিলোমিটার জুড়ে যেন বালু, পাথরখেকোদের অভয়ারণ্য।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ, বিএনপির স্থানীয় কিছু নেতা এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদীপাড়ের দরিদ্র শ্রমজীবীদের কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। এ কারণে ৪০০ গজ প্রস্থের যাদুকাটা এখন ২৫০০ গজের হয়েছে। যে যার মতো পাড় কাটছে। যেন ঠেকানোর কেউ নেই? প্রতিবাদ করলে নিশ্চিত আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
গত সোমবার যাদুকাটার এই লুটের মহোৎসবের ছবি তুলতে যাওয়ায় তাহিরপুরের সাংবাদিক কামাল হোসেনকে গাছে বেঁধে মারধর করা হয়েছে। এই ঘটনায় আবারও আলোচনায় যাদুকাটার পাথরখেকোরা।
১ জানুয়ারি তাহিরপুরের জনপ্রতিনিধিরা যাদুকাটার ভাঙন ও নদীর পাড় কাটা বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নানকেও লিখিত অভিযোগ দেন। তাৎক্ষণিক মন্ত্রী স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছেন।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু কোনো কিছুতেই থামছে না পাড় কাটা। মাঝে মাঝে প্রশাসনের অভিযান চললেও কিছু শ্রমিক আটক ও মামলার আসামি হয়। নেপথ্যের প্রভাবশালীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে।
সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা ঐতিহাসিক নদী যাদুকাটার বুকে ও তীরে স্থানীয় বালু, পাথর খেকোদের নির্যাতন বহু বছর ধরে চলে আসছে। একেক সময় একেক পক্ষের আধিপত্য থাকলেও লুটের উৎসবে সামিল থাকে সবাই। স্থানীয় প্রভাবশালী পরিবারগুলো ছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে অন্যান্য উপজেলার জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকদেরও এই নদীকেন্দ্রিক আয়ের উৎস রয়েছে।
সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এখনও ভিন্ন পন্থায় দিনে-রাতে শত শত কোয়ারি খনন এবং পাড় কেটে বালু বিক্রি করছে এক দল পাথর, বালু খেকো। এখনও কোয়ারি প্রতি লাখ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এই টাকা কোথায় যায় এটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে স্থানীয়ভাবে।
নদীর বুকে ৭ কিলোমিটার জুড়ে ঘাগরা থেকে বড়টেক ঘাগটিয়া পর্যন্ত শত শত পাথর কোয়ারি এই সময়েও দৃশ্যমান। ড্রেজার মেশিন দিয়ে দেড়’শ থেকে ২০০ ফুট খনন করা হয়েছে একেকটি কোয়ারি। এ কারণে নদীর পশ্চিম পাড়ের ১০টি এবং পূর্ব পাড়ের ১২টি গ্রামের বেশিরভাগই নদী গ্রাস করেছে। ৪০০ গজ প্রশস্তের নদী এখন ২৫০০ গজ প্রশস্ত হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জারগাঁও গ্রামের কয়েকজন জানান, নাম বললে বাড়ি এসে তারা মারপিট করবে। রাতভর গ্রামের ভেতরের সড়ক দিয়ে বালু-পাথরের ট্রাক আসা যাওয়া করে। প্রতিবাদ করলে মারধর করবে। এ কারণে কেউ এখন আর প্রতিবাদ করে না।
তাহিরপুরের গণমাধ্যমকর্মী গোলাম সারোয়ার লিটন ও আলম সাব্বির বলেন, যাদুকাটার পাড়ে ৩-৪ লাখ টাকায় ৩০-৪০ শতক জমি কিনে ৩-৪ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন অনেকে।
তাহিরপুর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে বালু, পাথর উত্তোলনের দায়ে তাহিরপুর থানায় শতাধিক ব্যক্তির নামে বিভিন্ন সময়ে মামলা ও অভিযোগ হয়েছে। এর মধ্যে ঘাগটিয়ার মুশাহিদ তালুকদার, মাহমুদ আলী শাহ্, মনির মেম্বার, রইছ উদ্দিন, দীন ইসলাম, লামা শ্রমের মুসলেম উদ্দিন, সোহেল মিয়া, রাজারগাঁওয়ের আশরাফ, ছমেদ মিয়া, সেতু রায় এবং সুভাষ রায়ের নাম রয়েছে।
স্থানীয় একাধিক গণমাধ্যমকর্মী জানিয়েছেন, বালু, পাথর কোয়ারিতে যারা কাজ করেন তাদের নামে মাঝে মধ্যেই মামলা হয়। কিন্তু নেপথ্যে থাকা ২০-২৫ জন প্রভাবশালীর নামে কখনও মামলা হয়নি। অথচ শ্রমিকদের কাটিয়ে তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। প্রভাবশালীরা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এই লুটপাট করছে। অথচ তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যম কর্মীরা জানান, গত ১ জানুয়ারি পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নানকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনেরা অবৈধভাবে নদীর পাড় কেটে এবং কোয়ারি খনন বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য লিখিত অভিযোগ করেন।
লিখিত অভিযোগে তারা বলেন, এভাবে চলতে থাকলে যাদুকাটায় নির্মিতব্য হযরত শাহ্ আরেফিন (র.) শ্রী অদ্বৈত মৈত্রী সেতু, বিন্নাকুলী বাজার, রাজারগাঁও, লামাশ্রম গ্রামসহ ৬০০ বছরের প্রাচীন শ্রী অদ্বৈত মন্দিরও হুমকির মধ্যে পড়বে।
তাহিরপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ বলেন, আমি যোগদানের পর সরকারি নির্দেশ কার্যকর করার জন্য নদীর আনোয়ারপুর এলাকায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। প্রতি মাসেই বালু মহাল আইনে একাধিক মামলা নেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই সময়ে ৭০-৮০ জনের নামে মামলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আগে কী হয়েছে জানি না? আমি যোগদানের পর পুলিশ সুপার মহোদয়ের নির্দেশে স্বচ্ছতার সঙ্গে এখানে কাজ করছে পুলিশ। বালু, পাথর মহাল থেকে বিভিন্ন সময় অভিযানে যারা আটক হয়; এদের বেশিরভাগই শ্রমিক শ্রেণির, এটা সত্য। কিন্তু তাদের দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদ করলেও নৌকার মালিক বা নেপথ্যের প্রভাবশালীদের নাম বলে না।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, যাদুকাটার পাড় কাটা এবং কোয়ারি খননের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী আমাদের নালিশ করেন। পুলিশসহ প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা অভিযানও পরিচালনা করেন। অভিযান হলে পাড় কাটা বা কোয়ারি খনন বন্ধ থাকে। আবার কদিন পর শুরু হয়ে যায়। এই অপকর্ম ঠেকাতে নদীর পাড়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
এসপি