‘আব্বা, গত পরশুদিন ভাতের জাউ আর একটা আলুসিদ্ধ খাইছিলাম। গতকাল কোনো খাওন দেয় নাই। আইজ ভাত দিব কইছিল, কিন্তু কারেন্ট নাই দেইখা ভাত রান্না করে নাই।’ লিবিয়ার বন্দিশালায় থাকা অবস্থায় ছেলের সঙ্গে হওয়া কথাগুলোর স্মৃতি এভাবেই স্মরণ করছিলেন ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে ঠান্ডায় মারা যাওয়া মাদারীপুর সদর উপজেলার জহিরুল ইসলাম শুভর (২০) বাবা শাহজালাল মাতুব্বর। 

সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ইতালির দূতাবাসের মাধ্যমে (তৃতীয় দফায়) জহিরুলের মরদেহ বাড়িতে পৌঁছানোর পর সকালে নিজ বাড়ির পাশে দাফন করা হয়। এর আগে মারা যাওয়া প্রথম দফায় ইমরান হাওলাদার ও দ্বিতীয় দফায় জয় তালুকদারের মরদেহ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন জহিরুল। তিনি মাধ্যমিকে ৪.৫৫ ও উচ্চমাধ্যমিকে ৪.৬৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বাবা শাহজালাল মাতুব্বর স্থানীয় একটি এনজিওতে কাজ করে কোনোমতে ৪ জনের সংসার চালিয়ে নিতেন। ছেলেকে ঠিকমতো পড়ার খরচ দিতেও পারতেন না। তাই জহিরুল এলাকায় ছাত্রদের পড়িয়ে নিজের পড়াশোনাসহ অন্যান্য খরচ বহন করতেন।

পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অনার্স প্রথম বর্ষে পড়াকালীন দালালের খপ্পরে পড়ে পরিবারের কষ্ট ঘোঁচাতে গত বছরের ডিসেম্বর মাসের ২৬ তারিখে বাংলাদেশ ছাড়ে জহিরুল। পরবর্তীতে কিছুদিন লিবিয়ায় বন্দিশালায় কাটানোর পরে ২৪ জানুয়ারি অবৈধভাবে সমুদ্রপথে লিবিয়া হয়ে কাঠের তৈরি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় ইতালীর পথে রওনা দেন। পথে তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে বৃষ্টিপাতের কবলে পড়ে ঠান্ডায় মারা যান জহিরুল ইসলাম শুভ। এ সময় তার সাথে মারা যান মাদারীপুরের আরও ৩ যুবক। এর মধ্যে সদর উপজেলার পশ্চিম পেয়ারপুর এলাকার মো. ইমরান হাওলাদার, একই ইউনিয়নের বরাইল বাড়ি এলাকার প্রেমানন্দ তালুকদারের ছেলে জয় তালুকদার। রাজৈর উপজেলার উমারখালী এলাকার সাফায়েত মোল্লা। 

জহিরুলের বন্ধু ফারুক আহম্মেদ বলেন, ছোট থেকে এক সাথেই বড় হয়েছি আমরা। জহিরুল খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে এ গ্রেড পেয়েছিল। দালালদের প্রলোভনে ইতালি যাওয়ার পথে মারা গেল। এটা মেনে নিতেই কষ্ট হচ্ছে আমাদের।

জহিরুলের বাবা শাহজালাল মাতুব্বর বলেন, আমার ছেলে ভালো ছাত্র ছিল। দালালদের ফাঁদে পড়ে আজ আমার ছেলেটা হারাইয়া গেল। সবাইকে এটাই বলার আছে কেউ যেন দালালদের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে তাদের সন্তানকে না পাঠায়। তবে আমি ধন্যবাদ জানাই জেলা সাংবাদিক ও মাদারীপুর নির্বাহী কর্মকর্তাকে, তাদের জন্য আজ আমার ছেলের মুখ দেখতে পেলাম। 

এ ব্যাপারে মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনুদ্দিন বলেন, আমরা নিহত পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করছি। আমরা আমাদের সাধ্যমতো ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পাশে থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করব।

নাজমুল মোড়ল/আরআই