ঘুষ কেলেঙ্কারি তদন্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের কমিটি
বাংলাদেশ ব্যাংক
ঘুষের বিনিময়ে হাজার হাজার কোটি টাকার লোপাটের তথ্য চাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক বর্তমান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। বিষয়টি তদন্তে উচ্চ পর্যায়ে কমিটি গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বুধবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক বর্তমান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি তদন্ত করতে ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় কর্মকর্তাদের ঘুষ কেলেঙ্কারির বিষয়ে সচিবালয়ে জাতীয় ক্রয় কমিটির বৈঠক শেষে এক প্রশ্নে জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বলেন, এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নেবে। আমরা এ বিষয়টি দেখব।
এর আগে ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠায় গত ৪ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব থেকে নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে সরিয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মতো একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। যাদের সহযোগিতা করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। ঘুষের বিনিময়ে গুরতর অনিয়মে সহায়তা করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার আরও বেশ কিছু কর্মকর্তা।
আদালতে ঘুষ কেলেঙ্কারির স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান। অনিয়মের অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরাও।
পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, একাধিক ব্যাংকার ও ব্যবসায়ী পিপলস লিজিংয়ের আর্থিক ভিত ধ্বংস করে দিয়েছে। জবানবন্দিতে প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাটে জড়িত হিসেবে শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের পরিচালক (অর্থ) আরেফিন শামসুল আলামিন, প্রতিষ্ঠানের সাবেক চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন (অব.) মোয়াজ্জেম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও সাবেক জিএম (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলমের নাম উল্লেখ করেন।
দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া উজ্জ্বল কুমার নন্দীর পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতিকুল ইসলামের আদালতে উজ্জ্বল কুমার নন্দী ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ নিয়ে জাতীয় গণমাধ্যমে সংবাদও প্রচার হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কেন ঘুষ দেওয়া হয়েছে তার বর্ণনা দিয়ে উজ্জ্বল কুমার নন্দী আদালতে বলেন, পিপলস লিজিংয়ের ডিপোজিট ও ধারের ওপর সুদ ১১১ কোটি টাকা বেশি দেখিয়ে সাবেক চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেমসহ ওই সময়ের পরিচালকরা তা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিজেরাই নিয়েছিলেন। ফলে এ সময়ে সম্পদ বেশি দেখানো হয়েছিল ৩০৯ কোটি টাকা ও দায় কম দেখানো হয়েছিল ৮৮৭ কোটি টাকা। এসব অপকর্ম ঢাকতে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর অডিটের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর, সাবেক জিএম (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলমসহ অন্যদের ১ কোটি টাকা করে সাড়ে ৬ কোটি টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে কিছু ভিআইপি ব্যক্তির জন্য মূলধন উপহার দেওয়া হয়েছিল মর্মে রেকর্ডপত্রে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া 'হুসা ভাসি' প্রতিবেদনে এ বিষয়টি স্পষ্টরূপে উল্লেখ রয়েছে।
এর আগে আদালতে পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হকের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাশেদুল হক। এর আগে দুদক তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়।
গত ২ ফেব্রুয়ারি রাশেদুল হক আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে দিতো রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দুই লাখ টাকা করে দেওয়া হতো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।
এসআই/এসএম