বাজেট শব্দটির উৎপত্তি হয় ‘বুজেট’ থেকে। বুজেট ফরাসি শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে মানিব্যাগ বা টাকার থলি। যদিও বাজেট ইংরেজি শব্দ হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। ১৭২০ সালে প্রথম বাজেট ও রাজস্বনীতি উত্থাপন করেছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী রবার্ট ওয়ালপুল। তবে বুজেট বা টাকার থলিকে বাজেটে রূপ দেওয়া হয়েছিল ১৭৩৩ সালে। যুক্তরাজ্যে রাজা দ্বিতীয় জর্জের সময়ে।

তখন যুক্তরাজ্যের চরম আর্থিক সংকট চলছিল। ওই সময়ে রবার্ট ওয়ালপুল নানা মহল থেকে তিনি কর সংক্রান্ত যত দাবি বা প্রস্তাব পেতেন, তা তার বুজেট বা মানিব্যাগে রেখে দিতেন।

তারপর যখন আনুষ্ঠানিকভাবে কর প্রস্তাব উত্থাপনের সময় এল, তিনি মানিব্যাগ থেকে সব বের করে একটা প্রস্তাব তৈরি করে তা পার্লামেন্টে উত্থাপন করলেন। সেটাই ছিল বিশ্বের প্রথম বাজেট।

আর ভারত উপমহাদেশের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন জেমস উইলসন। স্কটিশ এ ব্যবসায়ী ছিলেন ইন্ডিয়া কাউন্সিলের ফিন্যান্স মেম্বর। সিপাহি বিদ্রোহের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়। সরাসরি ব্রিটিশদের শাসন শুরু। সিপাহি বিদ্রোহের অবসানের তিন বছর পর জেমস উইলসন ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল উপমহাদেশের প্রথম বাজেটটি পেশ করেছিলেন।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ পূর্ববাংলা প্রদেশে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে জগন্নাথ হলের হলঘরে। সেখানেই ১৯৪৮-৪৯ সালের প্রথম বাজেট পেশ করেন পূর্ববাংলার অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী। ওই অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল সাড়ে ৪১ কোটি টাকা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ৩০ জুন একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন।

কালের ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত ৫০ বার বাজেট ঘোষণা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিবার বাজেট দিয়েছেন এক সময়ের চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে আসা বিএনপির অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। দুজনই ১২ বার করে বাজেট ঘোষণা দেন। তবে টানা ১০টি বাজেট দেওয়ার রেকর্ড শুধু মুহিতের।

বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিকেলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার ৫১তম বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। যেখানে চলতি অর্থবছরের বাজেট ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।

বাজেট বক্তৃতায় ৫০ বছরে দেশের বাজেট অধিবেশনে একাধিক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। অনেকে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অর্থমন্ত্রীদের অনেকে না ফেরার দেশে চলে গেলেও তাদের কথামালা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে।

অর্থমন্ত্রীদের আলোচিত কিছু বক্তব্য পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।

প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থনীতিবিদ হিসেবে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন তাজউদ্দিন আহমেদ। ওই সরকারের সময় তিনি তিন বার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন।

১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, গত অর্থবছর ছিল আমাদের জাতীয় জীবনের এক কঠিন পরীক্ষা ও সুমহান আশার ফল।

১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে তাজউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, সততা, নিয়মানুবর্তিতা, বাস্তবানুগ উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন ও কঠোর পরিশ্রমের আজ বড় প্রয়োজন। এ কথা সবার মনে রাখা দরকার শুধু স্লোগান দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় না, দুর্নীতি দূর হয় না, শুধু বুলি আউড়িয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায় না। এতে শুধু সাধারণ জনগণকে সর্বকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া চলে।

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান
সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে জিয়াউর রহমান বলেন, জাতি হিসেবে আমরা কেবল সঞ্চয় করাই শিখব না। আমাদের অপচয় করার প্রবণতাও পরিহার করা শিখতে হবে। সরকারি খাতের কতিপয় সংস্থার অতিমাত্রার অপচয় ও সম্পদের অপব্যবহার একটা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে পড়েছে।

এম সাইফুর রহমান
১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে এম সাইফুর বলেন, বিগত স্বৈরশাসনের আমলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনা, বাজেট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সব বিধি ও নৈতিকতা ক্রমান্বয়ে ভেঙে পড়ে।

১৯৯২-৯৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি নিম্ন আয় ও নিম্ন প্রবৃদ্ধির আবর্তে বন্ধ হয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের প্রবৃদ্ধি অতি শীর্ণ ও উন্নতির পরিমাণ নগণ্য।
এম সাইফুর রহমান ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে সুদক্ষ বিনিয়োগকারী হিসেবে সরকারের নাম নেই। যেখানে সরকার একচেটিয়া বিনিয়োগের অধিকারী সে ক্ষেত্রে এ কথা আরও সত্য।

২০০৩-০৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে একটি অত্যন্ত নাজুক ও ভারসাম্যহীন অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আমরা পেয়েছিলাম।

এম সাইফুর রহমান ২০০৬-০৭ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে সর্বাধিক ১২টি বাজেট ঘোষণা দেন।

শাহ এ এম এস কিবরিয়া
১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেন, অর্থনৈতিক সংস্কার কোনো দিনই সবাইকে সংশ্লিষ্ট করতে পারে না। কায়েমি স্বার্থে আঘাত না করে কোনো প্রকৃত সংস্কারই সম্ভব নয়।

২০০০-০১ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, এ সত্য কোনো প্রকারেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে গত ৪ বছর ধরে বাংলাদেশের যে হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এত উঁচুমানের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে এর আগে কখনোই সম্ভব হয়নি। শাহ এম এস কিবরিয়া তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬ বার বাজেট ঘোষণা দেন।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
২০০৭-০৮ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও সত্তরের দশকের প্রথমার্ধ থেকে এ পর্যন্ত সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত
২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রা থেমে যায় ২০০১ সালে। বিএনপি জোট সরকার শাসিত এ সময়ে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য ও সীমাহীন দুর্নীতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট তিনি বক্তব্যে বলেন, আমি আসলে কর্মশক্তি পাই আমার প্রবল তথা শোভনীয় আশাবাদে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরের পরে ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ বারসহ মোট ১২ বার বাজেট পেশ করেছেন।

আ হ ম মুস্তফা কামাল
বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ১২তম দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে তার প্রথম বাজেট পেশ করেন। অর্থমন্ত্রী প্রথম বারের মতো জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাজেট বক্তৃতা পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নজির। ২০১৯ সালের ১১ জুন বিকেল সাড়ে ৩টায় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা শুরু করলেও শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি বারবার থেমে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর তিনি সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে বিরতি নেন। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অর্থমন্ত্রীর পক্ষে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন।

২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা হয়েছিল ১১ জুন। যা ছিল তার দ্বিতীয় বাজেট। মাত্র ৫০ মিনিটে শেষ হয় ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন। আগের সব বাজেট উপস্থাপনে অর্থমন্ত্রীর ৩ থেকে ৫ ঘণ্টার মতো লেগেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাজেট উপস্থাপন হয়। আর অধিবেশনও বাংলাদেশের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম। মাত্র ৯ দিনের বাজেট আলোচনা ছিল।

২০২১-২০২২ অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের তৃতীয় বাজেট এবং আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের ত্রয়োদশ বাজেট পেশ করেন। ওই বাজেট বক্তৃতা অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে কোভিড-১৯ এর প্রাথমিক অভিঘাত মোকাবিলা করে বাংলাদেশ যখন অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুত গতিতে অর্থনৈতিক উত্তরণের পথে এগিয়ে চলছিল। তখনই সারাবিশ্বে দ্বিতীয়, কোথাও কোথাও তৃতীয় অভিঘাত শুরু হয় এবং যার প্রভাব সর্বত্রই প্রবল। তাই আমাদের এবারের বাজেটেও দেশ ও জাতির উন্নয়নের পাশাপাশি প্রাধিকার পাচ্ছে দেশের পিছিয়ে পড়া মানুষ-প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবন জীবিকা।

আর ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের চতুর্থ বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। যা চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৭৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা বেশি।

এছাড়াও অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেট ঘোষণা দিয়েছেন এম সাঈদুজ্জামান, অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল হক, ড. এ আর মল্লিক, ড. মির্জা নুরুল হুদা ও মেজর জেনারেল এম এ মুনেম। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট দেন ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

আরএম/এসএম