প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড

পিপলস ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মতো এবার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আব্দুল হামিদ মিয়ার বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তারাই এমন অভিযোগ এনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়েছেন।   

গত ৮ ফেব্রুয়ারি লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘প্রিমিয়ার লিজিংয়ের এমডি আব্দুল হামিদ মিয়া ভুয়া লোক সাজিয়ে, ভুয়া দলিলের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে লোন দিয়ে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। দুর্নীতি-অনিয়ম থেকে রক্ষা পেতে এখন তিনি স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে চেয়ারম্যান বরাবর আবেদনও করেছেন। পাশাপাশি অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করছেন।’

‘টাকার বিনিময়ে তার এসব অপকর্ম ঢাকতে সহযোগিতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক জিএম (বর্তমানে নির্বাহী পরিচালক) শাহ আলম’— এমন অভিযোগ আনেন খোদ প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা এ এস এম শফিকুল ইসলাম মানিক।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত প্রশাসকের পূর্বানুমোদন ছাড়া পরিচালক পদ থেকে আব্দুল হামিদ মিয়াকে অব্যাহতি সংক্রান্ত কোনো মেমো পর্ষদ সভায় উপস্থাপন থেকে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হলো

বাংলাদেশ ব্যাংক

অভিযোগপত্রটি আমলে নিয়ে তা যাচাই-বাছাই করছে বিএসইসি। তবে বিষয়টি অস্বীকার করে এমডি আব্দুল হামিদ মিয়া বলেন, ‘এটি বানোয়াট। উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।’

আব্দুল হামিদ মিয়ার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘২৫ শতাংশ কমিশন নিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে লোন দিতেন। এক্ষেত্রে লোনের কিস্তি না নিয়ে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিক সুবিধা দিতেন। এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ওয়েস্টার্ন মেরিন, ডেল্টা মিলার্স, এস এ গ্রুপ, বিশ্বাস টেক্সটাইল, অ্যাডভান্স, মেজর এম এ মান্নান এবং অন্যান্য আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।’

এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে। ঋণ নিয়ে যেসব অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই ঋণ আমার নিয়োগের আগেই বিতরণ করা

আব্দুল হামিদ মিয়া, এমডি, প্রিমিয়ার লিজিং

চিঠিতে বলা হয়, ‘যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে লোন দেয়া হয়েছে ওই লোনগুলো কীভাবে দেয়া হয়েছে তার সঠিক তদন্ত করলে আব্দুল হামিদ মিয়ার দুর্নীতি বেরিয়ে আসবে।’

‘আব্দুল হামিদ মিয়া বিদেশে পালানোর চেষ্টা করছেন’ উল্লেখ করা চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘এমডির এমন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থা বর্তমানে খুবই খারাপ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতি তিন মাস পরপর পরিদর্শক দল আসলে তিনি তাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতেন। এমনকি পরিদর্শক দলকে এ বলে হুমকিও দিতেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’

আব্দুল হামিদ মিয়ার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রিমিয়ার লিজিংয়ের এমডির বিষয়ে নানা অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যাচাই-বাছাই করছে।’

এমডির এমন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিতরণ করা ঋণ আদায় হচ্ছে না। ফলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণও পরিশোধ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমন অবস্থায় দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে চাচ্ছেন এমডি আব্দুল হামিদ মিয়া

শফিকুল ইসলাম মানিক, উদ্যোক্তা, প্রিমিয়ার লিজিং

অভিযোগের বিষয়ে এমডি আব্দুল হামিদ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছে। ঋণ নিয়ে যেসব অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই ঋণ আমার নিয়োগের আগেই বিতরণ করা।’

প্রিমিয়ার লিজিংয়ের উদ্যোক্তা শফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, এমডির এমন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বিতরণ করা ঋণ আদায় হচ্ছে না। ফলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণও পরিশোধ করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। এমন অবস্থায় দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে চাচ্ছেন এমডি আব্দুল হামিদ মিয়া।

তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এমডি যেন কোনোভাবেই পদত্যাগ করতে না পারেন, সেই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পর্ষদকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান বরাবর বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত প্রশাসকের পূর্বানুমোদন ছাড়া পরিচালক পদ থেকে আব্দুল হামিদ মিয়াকে অব্যাহতি সংক্রান্ত কোনো মেমো পর্ষদ সভায় উপস্থাপন থেকে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হলো।’

২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে প্রিমিয়ার লিজিং। ২০১৯ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদের পরিমাণ এক হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। যা ২০১৭ সালে ছিল এক হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির আমানত ৮১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯০ শতাংশই প্রাতিষ্ঠানিক আমানত। যার বেশিরভাগই ফেরত দিতে পারছে না প্রিমিয়ার লিজিং। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ এক হাজার ২৫১ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির কাছে প্রায় ৯০০ আমানতকারীর জমা ৯৫ কোটি টাকা। আমানত হিসেবে রাখা এ অর্থও ফেরত দিতে পারছে না প্রিমিয়ার লিজিং। এছাড়া ঋণ, মেয়াদি আমানত ও কলমানি হিসাবে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার রয়েছে ৭০০ কোটি টাকার বেশি। এ অর্থও ফেরত দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

এসআই/এমএআর