বড় ধরনের আর্থিক কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস। অনুমোদন ছাড়াই ঋণ নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা। নামে-বেনামে করেছেন অর্থ আত্মসাৎ। ঋণ-আমানতের তথ্যে রয়েছে গরমিল। বারবার সতর্ক করার পরও টনক নড়েনি। নানা অজুহাত দেখিয়ে আর্থিক প্রতিবেদন দিতে কালক্ষেপণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই এবার বাধ্য হয়ে অনিয়ম খুঁজে বের করতে উত্তরা ফাইন্যান্সে নিরীক্ষক দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম মঙ্গলবার ঢাকা পোস্টকে বলেন, উত্তরা ফাইন্যান্সের আর্থিক প্রতিবেদনে কিছু অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে তাদের আর্থিক প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়। কিন্তু না পাঠিয়ে বারবার সময় চাচ্ছে। তাই তাদের আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, উত্তরা ফাইন্যান্স নানা অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ সরিয়েছে, যার সঠিক তথ্য আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। ঋণ আমানতের তথ্যে গরমিল রয়েছে। তাদের সঠিক তথ্য দেওয়ার জন্য তাগিদ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু বারবার সময় নিয়েও তথ্য দিচ্ছে না। সবশেষ আজ (৯ মার্চ) তাদের আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু প্রতিবেদন পাঠায়নি। উল্টো ১০ দিন সময় চেয়ে আবেদন করেছে উত্তরা ফাইন্যান্স। এখন প্রতিষ্ঠানটিতে নিরীক্ষক নিয়োগের সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে রহমান রহমান হক চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে এই দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্বস্ত সূত্র।

এর আগে ২০১৮ সালে তিন গ্রাহকের ঋণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) ভুল তথ্য পাঠিয়েছিল উত্তরা ফাইন্যান্স। পরে ওই তিন গ্রাহককে ঋণ দিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ভুল তথ্য দেওয়ার অপরাধে উত্তরা ফাইন্যান্সকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে জরিমানা মওকুফ চেয়ে আবেদন করলেও তা নাকচ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে উত্তরা ফাইন্যান্সের কেলেংকারির প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়েই নিয়ম বর্হিভূতভাবে ঋণ নিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি তাদের অনেক লেনদেনের তথ্য গোপন করতে নথিপত্রও গায়েব করেছে।

এসব অনিয়মের কারণে উত্তরা ফাইন্যান্সের ২০১৯ ও ২০২০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন সংশোধনের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।

এসব বিষয়ে জানতে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে উত্তরা ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এস এম শামসুল আরেফিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান উত্তরা ফাইন্যান্স ১৯৯৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পায়। আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানটির আমানত ছিল ১ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা ও ঋণ ছিল ৩ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। আলোচিত বছরে উত্তরা ফাইন্যান্সের গ্রাহক ছিল ২ হাজার ৫৩৩ জন।

উত্তরা ফাইন্যান্স শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ১৯৯৭ সালে। সবশেষ চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা পরিচালকের হাতে রয়েছে ৪৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৩৫ দশমিক ০২ শতাংশ এবং বিদেশিদের কাছে রয়েছে ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ শেয়ার। এছাড়া বাকি ১২ দশমিক ৭২ শেয়ারের মালিক সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

এসআই/এনএফ