১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে জন্ম নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

রাষ্ট্রপতির ৭৬ নং আদেশে গঠিত হয় অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে নেতৃত্ব দেওয়া সবচেয়ে বড় এ প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ পথচলায় স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে এনবিআরের সক্ষমতা বেড়েছে ১ হাজার ৩১৩ দশমিক ৩৪ গুণ। প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতায় ধীরে ধীরে শতভাগ আত্মনির্ভরশীলতার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।

প্রতিবছরই বাড়ছে এনবিআরের সক্ষমতা। যেখানে প্রতিষ্ঠানটির গঠনের বছরে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় ছিল মাত্র ১৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা, সেখানে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এনবিআর আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাত থেকে রাজস্ব আদায় করেছে ২ লাখ ১৮ হাজার ৪০৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।

৪৯তম বছরে এসে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার ২৪৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। যা এনবিআরের জন্মের অর্থবছর থেকে ১ হাজার ৩১৩ দশমিক ৩৪ গুণ বেশি। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রায় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে আমাদের মাথাপিছু আয় অনেক বেড়েছে। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশ থেকে অনেক ভালো করছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বেড়েছে। আমাদের ভ্যাট আদায় বেড়েছে, বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান দেশে বিনিয়োগ করছে। ফলে রাজস্ব আদায় অনেক বেড়েছে, যা ভবিষ্যতেও বাড়তে থাকবে।

তিনি বলেন, আগে আমাদের বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক সংস্থাগুলোর বৈদেশিক সাহায্যে ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হতো। বর্তমানে বাজেটে আর তাদের ওই প্রভাব নেই। এখন আমাদের জনশক্তি রফতানি ও তৈরি পোশাক খাতের মাধ্যমে বড় অংকে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। যার ফলে পর নির্ভরশীলতা অনেকটা কমেছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো আয় বৈষম্য। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে দেখা যায়, বৈষম্য বেড়েছে। যেটা নীতি নির্ধারকরা এখন আর বলেন না।

এনবিআরের বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এনবিআর গঠনের পর বাংলাদেশের প্রথম বাজেটে (১৯৭২-৭৩) সংস্থাটিকে ২৫০ কোটি ৭১ লাখ টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়। সেই সময় ১৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা আদায় করতে সক্ষম হয় প্রতিষ্ঠানটি। আর এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মোট ১৬৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয় স্বাধীনতার প্রথম অর্থবছরে। কর জিডিপি অনুপাত ছিল মাত্র ৩.৪১ শতাংশ।

ঠিক দশ বছর পর ১৯৮১-৮২ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ হাজার ৮১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। যার মধ্যে এনবিআর ১ হাজার ৮৫৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় করে। আর এনবিআর বহির্ভূত কর রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১২৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। মোট ১ হাজার ৯৭৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকার রাজস্ব আদায় সক্ষম হয় দেশ। দশ বছর পর কর জিডিপি অনুপাত ছিল ৫.৪৭ শতাংশ।

তবে কর জিডিপি অনুপাত ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে এসে দ্বিগুণ অর্থাৎ ১০.৪৯ শতাংশ হয়। এই অর্থবছরে ৭২ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৮২ হাজার ৬৩২ কোটি ১১ লাখ টাকা। যার মধ্যে এনবিআর থেকে আদায় করা হয় ৭৯ হাজার ৪০৩ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব আদায় ছিল ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা।

শুরুতে এনবিআর রাজস্ব আদায়ে আমদানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক ও বিক্রয় করের ওপর নির্ভরশীল ছিল। যৎসামান্য আয়কর আদায় হতো। তখন ১৬৬ কোটি টাকার মধ্যে আমদানি শুল্ক খাতে ৬৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, আবগারি শুল্ক হিসেবে ৫৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা, বিক্রয় কর হিসেবে ২০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা এবং ১০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা আয়কর ও অন্যান্য কর বাবদ ৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা আয় করত। এরপর থেকে প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়তে থাকে।

সর্বশেষ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকার বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়েছে ২ লাখ ১৮ হাজার ৪০৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এই অর্থবছরের প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যদিও পরবর্তীতে লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছিল।

এনবিআর থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ওই অর্থবছরে ভ্যাট, আয়কর ও কাস্টমসে রাজস্ব আদায় হয়েছিল পর্যায়ক্রমে ৮৪ হাজার ৮৫২ কোটি ৫০ লাখ, ৭৩ হাজার ৪ কোটি ২১ লাখ এবং ৬০ হাজার ৫৫২ কোটি লাখ টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ঋণাত্মক ২.২৬ শতাংশ।

আর চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, আয়কর ও ভ্রমণ কর থেকে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি এবং আমদানি শুল্ক থেকে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। যেখানে ৮ মাসে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয় ১ লাখ ৫১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ৪.০৫ শতাংশ। কর জিডিপি ১৪ লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে চলছে রাজস্ব আদায়ের কাজ।

আরএম/এসএসএইচ