বাজেটে অর্থমন্ত্রীদের আলোচিত যত বক্তব্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদ ৭৮৬ কোটি টাকার প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন। কালের ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত ৪৯ বার বাজেট হয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী বার বাজেট দিয়েছেন এক সময়ের চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট পরবর্তীতে রাজনীতিতে আসা বিএনপির অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। দুজনই ১২ বার করে বাজেট ঘোষণা দেন। তবে টানা ১০টি বাজেট দেওয়ার রেকর্ড শুধু মুহিতের।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (৩ জুন) বিকেলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ৫০তম বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন। যা চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে ৩৫ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা বেশি।
বাজেট বক্তৃতায় ৪৯ বছরে দেশের বাজেট অধিবেশনে একাধিক অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। অনেকে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অর্থমন্ত্রীদের অনেকে না ফেরার দেশে চলে গেলেও তাদের কথামালা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রীদের আলোচিত কিছু বক্তব্য পুনরায় পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।
বিজ্ঞাপন
প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দন আহমেদ
মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থনীতিবিদ হিসেবে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন তাজউদ্দিন আহমেদ। ওই সরকারের সময় তিনি তিন বার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন।
১৯৭৩-৭৪ সালের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, গত অর্থবছর ছিল আমাদের জাতীয় জীবনের এক কঠিন পরীক্ষা ও সুমহান আশার ফল।
১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে তাজউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, সততা, নিয়মানুবর্তিতা, বাস্তবানুগ উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন ও কঠোর পরিশ্রমের আজ বড় প্রয়োজন। এ কথা সবার মনে রাখা দরকার শুধু স্লোগান দিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যায় না, দুর্নীতি দূর হয় না, শুধু বুলি আউড়িয়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যায় না। এতে শুধু সাধারণ জনগণকে সর্বকালের জন্য ধোঁকা দেওয়া চলে।
মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান
সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে জিয়াউর রহমান বলেন, জাতি হিসেবে আমরা কেবল সঞ্চয় করাই শিখব না। আমাদেরকে অপচয় করার প্রবণতাও পরিহার করা শিখতে হবে। সরকারি খাতের কতিপয় সংস্থার অতিমাত্রার অপচয় ও সম্পদের অপব্যবহার একটা গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে পড়েছে।
এম সাইফুর রহমান
১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে এম সাইফুর বলেন, বিগত স্বৈরশাসনের আমলে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয়। সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনা, বাজেট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সকল বিধি ও নৈতিকতা ক্রমান্বয়ে ভেঙে পড়ে।
১৯৯২-৯৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি নিম্ন আয় ও নিম্ন প্রবৃদ্ধির আবর্তে বন্ধ হয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের প্রবৃদ্ধি অতি শীর্ণ ও উন্নতির পরিমাণ নগণ্য।
এম সাইফুর রহমান ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে সুদক্ষ বিনিয়োগকারী হিসেবে সরকারের নাম নেই। যেখানে সরকার একচেটিয়া বিনিয়োগের অধিকারী সে ক্ষেত্রে এ কথা আরও সত্য।
২০০৩-০৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের নিকট থেকে একটি অত্যন্ত নাজুক ও ভারসাম্যহীন অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আমরা পেয়েছিলাম।
এম সাইফুর রহমান ২০০৬-০৭ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে সর্বাধিক ১২টি বাজেট ঘোষণা দেন।
শাহ এ এম এস কিবরিয়া
১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেন, অর্থনৈতিক সংস্কার কোনো দিনই সবাইকে সংশ্লিষ্ট করতে পারে না। কায়েমি স্বার্থে আঘাত না করে কোনো প্রকৃত সংস্কারই সম্ভব নয়।
২০০০-০১ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যে তিনি বলেন, এ সত্য কোনো প্রকারেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে গত ৪ বছর ধরে বাংলাদেশের যে হারে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এত উঁচুমানের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে এর আগে কখনোই সম্ভব হয়নি।
শাহ এম এস কিবরিয়া তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬ বার বাজেট ঘোষণা দেন।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
২০০৭-০৮ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ অর্থ উপদেষ্টা বলেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও সত্তরের দশকের প্রথমার্ধ থেকে এ পর্যন্ত সময়ের পরিক্রমায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
আবুল মাল আবদুল মুহিত
২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রা থেমে যায় ২০০১ সালে। বিএনপি জোট সরকার শাসিত এ সময়ে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য ও সীমাহীন দুর্নীতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট তিনি বক্তব্যে বলেন, আমি আসলে কর্মশক্তি পাই আমার প্রবল তথা শোভনীয় আশাবাদে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরের পরে ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ বারসহ মোট ১২ বার বাজেট পেশ করেছেন।
আ হ ম মুস্তফা কামাল
বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ১২তম দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে তার প্রথম বাজেট পেশ করেন। চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকার বাজেট ঘোষণা হয়েছিল ১১ জুন। যা ছিল তার দ্বিতীয় বাজেট। মাত্র ৯ দিনের বাজেট আলোচনা ছিল, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ততম অধিবেশন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথম বারের মতো জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করার সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে বাজেট বক্তৃতা পাঠ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নজির।
২০১৯ সালের ১১ জুন বিকেল সাড়ে ৩টায় অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা শুরু করলেও শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি বারবার থেমে যাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর তিনি সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে বিরতি নেন। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অর্থমন্ত্রীর পক্ষে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন।
আর ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট হচ্ছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের তৃতীয় বাজেট এবং আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদের ত্রয়োদশ বাজেট।
এছাড়াও অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেট ঘোষণা দিয়েছেন এম সাঈদুজ্জামান, অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল হক, ড. এ আর মল্লিক, ড. মির্জা নুরুল হুদা ও মেজর জেনারেল এম এ মুনেম। ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট দেন ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
আরএম/ওএফ