আমরা, বৈশ্বিক নাগরিক হিসাবে এরইমধ্যে তিনটি প্রান্তিকের বেশি কাটিয়ে দিয়েছি মহামারি পরিস্থিতি মোকাবিলায়। স্বাস্থ্যসেবায় যেসব দেশের অবস্থান  একেবারে তলানির দিকে তারা তো বটেই, এ খাতে সেরা দেশগুলোকেও আর্থিকভাবে ধুকতে হয়েছে এ সময়টাতে। ভাইরাসজনিত ক্ষতি কেবল মানুষের জীবনের ওপর দিয়ে গেছে তা নয়, বিভিন্ন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সাথে সাথে ব্যক্তিমানুষের অর্থনীতিতেও এ ভাইরাসের আঘাত ছিল ধারণার চেয়ে অনেক বেশি জোরালো। 

অর্থনীতির মারাত্মক রকমের ক্ষতি হয়েছে, উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, বহু দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো, বেকারত্বের হার বেড়েছে, পুরো বিষয়টা একটি প্রজন্মের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু সম্মিলিতভাবেই আমরা সেই বিপদের মুখ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, পুরোনো বিশ্বকে পেছেনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি নতুন এক পৃথিবীতে।   

তবে এই নতুনের মূল্য চুকানো এখনও বাকি রয়েছে। নতুন এই পৃথিবী কতটা বিশ্বাসযোগ্য, কেমন তার দায়বদ্ধতা, কী হবে তার প্রতিক্রিয়া এবং কতটা স্থায়ী হবে- সেসব বিষয়ে এখনও কারো সামগ্রিক কোনো ধারণা নেই।  এই ধারণা না থাকার কারণটি মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির ক্ষেত্রে 'প্যারাডাইম শিফট।' কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সক্ষমতার পাশপাশি লড়াইয়ের গোটা এই সময়টাতে ডেভলপমেন্ট প্র্যাকটিশনার ও নীতিনির্ধারকদের আরও একটি বিষয় মাথায় রাখতে হয়েছে  তা হলো- তার নিজ দেশের ঋণের অবস্থা। 

স্বাস্থ্যসেবায় যেসব দেশের তহবিল সীমিত, সবচেয়ে খারাপ সময় গেছে সেসব দেশে। একদিকে তাদের মাঠ পর্যায়ের কাজগুলো স্থবির হয়ে যায়, অন্যদিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল প্রাপ্তির বিষয়টা পড়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে। 

মূলত দেশগুলো এই শতাব্দীর শুরুর (২০০০ সাল) অবস্থায় ফিরে গেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে- মহামারির এই সময়টাতে গড় বৈশ্বিক-ঋণ সবেচয়ে বেশি বেড়েছে এবং পরের দুই প্রান্তিকে তা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এ পরিস্থিতিকে 'ঋণ সুনামি' বলে আখ্যা দিয়েছে। পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত তথ্য থেকেই এ আখ্যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। চলতি বছরের শেষ নাগাদ বৈশ্বিকঋণের পরিমাণ ২৮০ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। আশঙ্কা সত্য হলে ঋণের ওই পরিমাণ হবে বৈশ্বিক জিডিপির ৩৬০ শতাংশ। 

মহামারি শুরুর পর প্রথম তিন প্রান্তিকেই বৈশ্বিক ঋণ ১৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার বেড়েছে। দ্য গ্লোবাল ডেবিট মনিটরিং রিপোর্ট বলছে,  বৈশ্বিক ঋণে এই যে পরিবর্তন এসেছে তার বড় কারণের মধ্যে রয়েছে- মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং কোভিড চিকিৎসায় স্বাস্থ্যখাতে বাড়তি যে ধাক্কা গেছে সেটা।     

উন্নত দেশগুলো এক্ষেত্রে ঋণের নতুন রেকর্ড দেখেছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এসব দেশে সরকার ঘোষিত বিভিন্ন প্যাকেজের কারণে মূলত এই অবস্থার তৈরি হয়। বৈশ্বিক-ঋণ বৃদ্ধির এই ধারা আমাদের সকলের জন্য খুবই উদ্বেগজনক একটা ব্যাপার। এই ঋণ একসময়ে উন্নয়নশীলসহ উন্নত অর্থনীতিতেও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের চাপে ফেলবে। 

২০০৮-০৯ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও তারও আগে ১৯৯৭-৯৮ সালের মন্দার সময় একই ধরনের বৈশ্বিক সঙ্কট দেখা গিয়েছিল। সামনের তিন থেকে চারটি প্রান্তিকে আমরা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি। আসন্ন এ পরিস্থিতির লক্ষণ হিসেবে থাকতে পারে- বিভিন্ন দেশে ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের মুখ থুবড়ে পড়া, কোনো কোনো দেশে মুদ্রাস্ফীতি ও  অত্যাধিক মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনীতির ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা,  ঋণ গ্রহণের হার ও জিডিপির অনুপাত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া, বড় ও মাঝারি আকারের শিল্প ও পরিষেবার ক্ষেত্রে বিপর্যয়। 

উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে নির্দিষ্ট কিছু দেশের এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপের বিকল্প নেই। নিকট ভবিষ্যতের এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এজেন্সি। এসব এজেন্সি তাদের কাজের ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে মূলত মনোযোগ দিচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে- স্থানীয় অর্থনীতিকে টেকসই করার উপায় বের করা, উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক ইকোসিস্টেমের উন্নতিসাধন, বিপদে থাকা বিভিন্ন খাতের উন্নতিসাধনে গৃহীত নীতিগুলো ভাগাভাগি করা ইত্যাদি।  এ অবস্থায় কী পরিস্থিতি সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেটিই এখন দেখার পালা।  

মূল লেখা: টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত ভারতের পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল রিসোর্স পারসন অজ্ঞেয় ত্রিপাঠীর স্ট্যাটাস অব গ্লোবাল ডেবিট ডিউরিং কোভিড-১৯। অনুবাদ : নাঈম ফেরদৌস রিতম।