রাজধানীর যানজট নিরসনে বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেল প্রকল্প। ছবি : ঢাকা পোস্ট

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বড় যত স্বপ্ন দেখেছে, তার অন্যতম দুটি হলো পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল। এ দুই প্রকল্পের হাত ধরে যোগাযোগ ব্যবস্থায় দৃশ্যত এখন কেবল নতুন এক পথের অপেক্ষা। এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে গিয়ে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি মোকাবিলা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বা বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো প্রকল্পে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি কমাতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিমা করা হলেও এবার সে চ্যালেঞ্জ নিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানই। 

পদ্মা সেতুর পর দেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল প্রকল্পে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি কমাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বিমা করপোরেশনের (এসবিসি) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। এসবিসিতে আট ভাগে এই প্রকল্পের বিমা করা করা হয়েছে; যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩১ লাখ ১০ হাজার ৫২২ টাকা। বিমার মেয়াদ শেষ হবে ২০২২ সালে। এসবিসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ঢাকা ও আশপাশের এলাকাকে যানজটমুক্ত করতে ও পরিবেশের উন্নয়নে অত্যাধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সরকার মেট্রোরেল প্রকল্প হাতে নেয়। ২০ দশমিক ১ কিলোমিটারের বেশি এই মেট্রোরেল প্রকল্পকে আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগের জন্য আলাদা বিমা করেছে নন-লাইফ কোম্পানি এসবিসি। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতুর চেয়েও বড় এই প্রকল্পের বিমা দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান পাওয়ায় এ খাতে আস্থা বাড়বে। পাশাপাশি দেশের অর্থ দেশেই থেকে যাবে। অন্যদিকে নিজেদের অর্থায়নে করা পদ্মা সেতুর পাশাপাশি তার চেয়ে বড় প্রকল্প মেট্রোরেলের বিমা নিজ দেশের প্রতিষ্ঠানের অধীনে থাকা এ খাতের জন্য বড় অর্জন। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিমা কোম্পানিগুলোকে জানান দেওয়া হলো যে, দেশের বিমা কোম্পানিগুলোর সক্ষমতা বেড়েছে। 

আমাদের বিমাখাত এগিয়ে যাচ্ছে তার প্রমাণ পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্পের বিমা। এক সময় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং বঙ্গবন্ধু সেতুসহ বড় প্রকল্পগুলোর বিমা দেশের বাইরের কোম্পানির সঙ্গে করা হয়েছিল। এখন এ ধরনের বিমা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা হচ্ছে।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেন

সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের জন্য ১৩ হাজার ৫২১ কোটি সাত লাখ ৬৮ হাজার ৩০৬ টাকার ঝুঁকি বিমা করা হয়েছে; যার প্রিমিয়াম দাঁড়িয়েছে ৪২ কোটি ৪১ লাখ ৫১ হাজার ৫০১ টাকা।

এসবিসির তথ্য মতে, মেট্রোরেলের প্রথম বিমা শুরু হয় ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। মেট্রোরেলের কার্যক্রম শুরুর সরঞ্জাম অর্থাৎ ক্রেন, কোস্টার এবং মেশিনসহ মাটি খনন প্রক্রিয়ার সরঞ্জামের ঝুঁকি কমাতে ৫৬৭ কোটি ২ লাখ ২৬ হাজার ৮ টাকার বিমা করা হয়; যার মেয়াদ ছিল ৭৬০ দিন। বিমার প্রিমিয়াম ছিল ৩ কোটি ১২ লাখ ২৭ হাজার ৩৪৭ টাকা। এরপর এর মেয়াদ বাড়ানো হয়।

দ্বিতীয় বিমাটি করা হয় উত্তরা ডিপোর জন্য। মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত মেট্রোরেলের উত্তরা ডিপো স্টেশনের ভবন এবং সরঞ্জামের ঝুঁকির জন্য করা হয় ১ হাজার ৪০৬ কোটি ৭৮ লাখ ৪১৫ টাকার বিমা। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে শুরু হওয়া বিমার মেয়াদ শেষ হবে ২০২২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। তার জন্য প্রিমিয়াম দাঁড়ায় ৫ কোটি ৬২ লাখ ৭১ হাজার ২০২ টাকা। উত্তরা থেকে বিমানবন্দর, কাওলা এবং বিশ্বরোড পর্যন্ত এই ডিপোর এলাকা। এসবিসির সঙ্গে বিমাটি করেছে ইতালিয়ান কোম্পানি ইতালিয়ান থাই ডেভেলপমেন্ট এবং চীনা প্রতিষ্ঠান সাহনো হাইড্রো।

মিরপুর ১, ২ এবং কালশি এলাকার জন্য করা হয় তৃতীয় বিমা আর মিরপুর ১০, ১১, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া এবং আগারগাঁও এলাকার জন্য করা হয় চতুর্থ বিমা। মেট্রোরেলের এ দুই অংশে ঝুঁকি বিমা করে ইতালিয়ান থাই কোম্পানি। এ দুই অংশের জন্য মোট বিমা ৩ হাজার ৭৩৮ কোটি ৯৮ লাখ ৭৬ হাজার ২৫৯ টাকা। বিমার মেয়াদ শুরু হয়েছে ২০১৭ সালের ১ আগস্ট। শেষ হবে ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট। এই বিমার প্রিমিয়াম ১৫ কোটি ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৯৯৯ টাকা।     

৯ মার্চ মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্পের যে অগ্রগতির তথ্য প্রকাশ করেছে সেখানে বলা হয়েছে, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) আওতাধীন প্যাকেজ-৬ এর উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৮১.৪২ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।

বিজয় সরণি, ফার্মগেট এবং কারওয়ান বাজার এলাকার মেট্রোরেল প্রকল্পে করা হয়েছে পঞ্চম বিমা। এই প্রকল্পের বিমার অংক ১ হাজার ৬৪১ কোটি ৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৩ টাকা। বিমার প্রিমিয়াম হয়েছে ৬ কোটি ১৯ লাখ ৬১ হাজার ৮১৬ টাকা। বিমার মেয়াদ ১ আগস্ট ২০১৮ থেকে ২৫ জানুয়ারি ২০২২ সাল পর্যন্ত। এই বিমাটি এসবিসির সঙ্গে করেছে টিক্কেন করপোরেশন। তার সঙ্গে রয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম এবং এবেনকো কোয়েক্সম।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বর দেশের প্রথম মেট্রোরেল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পরিকল্পনা রয়েছে। জাপানের কোবে বন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে দেশের প্রথম মেট্রো ট্রেন সেট। এ বছরের ২৩ এপ্রিল উত্তরার ডিপোতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

শাহবাগ, টিএসসি, প্রেসক্লাব, পল্টন হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত এলাকার জন্য করা হয়েছে ষষ্ঠ বিমা। এই এলাকার বিমার পরিমাণ ১ হাজার ৯৩৯ কোটি ৯১ লাখ ৭৮ হাজার ৮১ টাকা। প্রিমিয়াম ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৭৮ লাখ ৯৭ হাজার ১২৪ টাকা। বিমার মেয়াদ ২০১৮ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২২ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

মেট্রোরেলের জন্য নির্মিত স্টেশনগুলোর জন্য থাকা চলন্ত সিঁড়ি এবং সিঙ্গেল লাইটসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো থাকছে সপ্তম বিমার আওতায়। এই বিমার পরিমাণ ৩ হাজার ৯০৫ কোটি ৯৬ লাখ ৯২ হাজার ৬৪৭ টাকা। বিমার প্রিমিয়াম ১১ কোটি ৫২ লাখ ২৬ হাজার ৯৩ টাকা। ২০১৮ সালের ১১ জুলাই শুরু হওয়া বিমার মেয়াদ ৫০ মাস অর্থাৎ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

সর্বশেষ বিমা করা হয়েছে মেট্রোরেলের সকল ডিপোর যন্ত্রাংশের জন্য। এই বিমার আকার ৩ হাজার ২৯৬ কোটি ৫৯ লাখ ৮৯ হাজার ৩১ টাকা; যার প্রিমিয়াম ৭ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ৫৮৬ টাকা। এ বিমাটি সম্পন্ন করেছে কাওয়াসাকি হেভি ইন্ডাট্রিজ।

সব মিলে ৮টি বিমার মাধ্যমে এসবিসির সঙ্গে মোট ১৬ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩১ লাখ টাকার বিমা করা হয়েছে; যার মোট প্রিমিয়াম ৫৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সরকারি নিয়ম অনুসারে দেশের প্রতিটি সম্পদের বিমা করতে হয়। বেশিরভাগ দেশে বিমা বাধ্যতামূলক হলেও বাংলাদেশে এর প্রচলন তুলনামূলক কম। তবে বর্তমানে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এই আইনটির দিকে নজর দিচ্ছে।

এ বিষয়ে সাধারণ বিমা করপোরেশনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন বা বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। এ প্রকল্পটি সাধারণ বিমা করপোরেশনে বিমাকৃত।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের বিমা খাত এগিয়ে যাচ্ছে তার প্রমাণ পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্পের বিমা। এক সময় ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং বঙ্গবন্ধু সেতুসহ বড় প্রকল্পগুলোর বিমা দেশের বাইরের কোম্পানির সঙ্গে করা হয়েছিল। এখন এ ধরনের বিমা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা হচ্ছে। 

আধুনিক নগর পরিকল্পনায় ও গণপরিবহনে সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে দেখা হয় মেট্রোরেলকে। ছবি : ঢাকা পোস্ট

মেট্রোরেল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। বাঁচবে সময়, কমবে মানুষের ভোগান্তি। মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। দেশের উন্নয়ন হবে। জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এই লক্ষ্যে রাজধানীর যানজট নিরসন, যাত্রী দ্রুত পরিবহনের জন্য উন্নত বিশ্বের মতোই মেট্রোরেল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, জাপানের সহায়তায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার মেট্রোরেলের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত পথগুলোর একটি হচ্ছে মিরপুর থেকে মতিঝিল। এই পথে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। এই প্রকল্পের কাজের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। 

এটি ছাড়াও ঢাকা ও এর শহরতলিকে যুক্ত করতে আরও পাঁচটি মেট্রোরেল পাতাল ও উড়ালপথে হবে। এর মধ্যে কমলাপুর-বিমানবন্দর (১৯ দশমিক ৮৭ কিমি) পাতালপথে এবং নতুন বাজার-পূর্বাচল (১১ দশমিক ৩৭ কিমি) উড়ালপথে মেট্রোরেলের স্টেশনের সংখ্যা ২১। এ প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত। ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকা। অনুমোদিত আরেকটি প্রকল্প হলো সাভারের হেমায়েতপুর-আমিনবাজার (সাড়ে ৬ কিমি) উড়ালপথে এবং গাবতলী-ভাটারা (সাড়ে ১৩ কিমি) পাতালপথে মেট্রোরেল। এতে স্টেশনের সংখ্যা ১২টি। এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা।

এছাড়া গাবতলী থেকে চিটাগাং রোড (২৪ কিলোমিটার), কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ (১৬ কিলোমিটার), গাবতলী থেকে দাসেরকান্দি (১৭ দশমিক ৪০ কিলোমিটার) মেট্রোরেল নির্মাণ পরিকল্পনায় রয়েছে।

সরকার ২০০৫ সালে ঢাকার জন্য ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) অনুমোদন করে। এতে যানজট নিরসনে ২০২৪ সালের মধ্যে একাধিক মেট্রোরেলসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি (ডিএমটিসিএল)। ২০১৫ সালে জাপানের সহায়তায় এসটিপি সংশোধন (আরএসটিপি) করে মেট্রোরেলের রুট সংখ্যা বাড়ানো হয়।

এমআই/এনএফ/এমএমজে