রঞ্জন তালুকদার। সঞ্চয়ের ১৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন পুঁজিবাজারে। দুই বছরে লাভসহ তার বিনিয়োগ দাঁড়ায় ২৫ লাখ টাকা। ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু মার্জিন ঋণের ফাঁদে পড়েন রঞ্জন। দুই দফা ১৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এখন পড়েছেন বিপদে। লাভের অংশ শেষ, পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা এ বিনিয়োগকারী।

মার্জিন ঋণের বিপাকে আরেক বিনিয়োগকারী শাহিদুর রহমান দিপু। লোভে পড়ে আসল ও মুনাফার টাকার সঙ্গে মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু বাজার ধসে ২৮ লাখ টাকার বিনিয়োগ নেমে দাঁড়িয়েছে তিন লাখে। অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা হাওয়া।

রঞ্জন ও দিপুর মতো লাখ লাখ বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণ নিয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই সঞ্চয়ের সমপরিমাণ মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। এরপর যখন দরপতন শুরু হয়, ব্রোকাররা নিজেদের টাকা তুলে নিতে মার্জিন অ্যাকাউন্টের শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি (ফোর্সসেল) করে দেন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়, ধস নামে বাজারে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৩৩ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনার্সধারী (বিও) বিনিয়োগকারীর মধ্যে মার্জিন ঋণ নেওয়াদের নেগেটিভ ইক্যুইটি ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। একের পর এক সুবিধা দিয়ে যা গত ১২ বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা কমে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকার হাউজগুলো এখনও সেই লসের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে যখনই দরপতন হয়, তখনই এ মার্জিন ঋণ দেওয়া ব্রোকার হাউজগুলো শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুল নেয়। এতে দরপতন প্রলম্বিত হয়। বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত পুঁজি হারান।

লাখ লাখ বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণ নিয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন / প্রতীকী ছবি

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্জিন ঋণের কারণে বাজারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন হয়। ফলে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও পুঁজিবাজারের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে মার্জিন ঋণ পরিহার করা উচিত। তাহলে প্রকৃত বিনিয়োগ বাড়বে, কমবে কারসাজি। ২০১০ সালের পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনেও পুঁজিবাজারে ধসের পেছনে মার্জিন ঋণকে দায়ী করা হয়। সেখানে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ পরিহারের সুপারিশও করা হয়।

রঞ্জন ও দিপুর মতো লাখ লাখ বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণ নিয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই সঞ্চয়ের সমপরিমাণ মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। এরপর যখন দরপতন শুরু হয়, ব্রোকাররা নিজেদের টাকা তুলে নিতে মার্জিন অ্যাকাউন্টের শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি (ফোর্সসেল) করে দেন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়, ধস নামে বাজারে

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যত দূর সম্ভব ঋণ না করেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত। পুঁজিবাজারে ঝুঁকি থাকবেই। ঋণ না করে সঞ্চিত অর্থ থেকে বিনিয়োগ করা ভালো। যারা মার্জিন লোন নেন, তারা লোভে পড়ে নেন। দরপতনে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

রঞ্জন তালুকদারের গল্পে আবার ফিরে আসি। ২০২০ ও ২০২১ সালে সঞ্চয়ের ১৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন আইডিএল সিকিউরিটিজের এ বিনিয়োগকারী। দুই বছরে লাভসহ তার বিনিয়োগ দাঁড়ায় ২৫ লাখ টাকা। লাভ ভালো হওয়ায় খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক এ কর্মকর্তা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবার মূল টাকার সঙ্গে আরও আট লাখ টাকা মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন। সেখানেও মুনাফা করেন। এবার তিনি আরও পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন।

দ্বিতীয় দফা বিনিয়োগের পর মাস না যেতেই চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় দরপতন। যা অব্যাহত ছিল গত ২৬ মে পর্যন্ত। থেমে থেমে চলা দরপতনে বিনিয়োগের ৩৮ লাখ টাকা কমে দাঁড়ায় ২১ লাখ ৪৭ হাজারে।

পুঁজি হারানো রঞ্জন তালুকদার ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখনই টাকার পরিমাণ ২১ লাখ ৪৭ হাজারে দাঁড়ায়, ব্রোকার হাউজ আমাকে শেয়ার বিক্রির তাগাদা দেওয়া শুরু করে। হাউজটি মার্জিন ঋণের ১৩ লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি করে সমন্বয় করে। এখন আমার বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ লাখ ৮৫ হাজার টাকায়।

লোভে পড়ে মার্জিন ঋণ নিয়েছিলাম। এখন আমার সঞ্চয় ও মুনাফা দুই-ই গেল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে যখন এসব কথা বলছিলেন তখন রঞ্জনের পাশে থাকা আরেক বিনিয়োগকারী শাহিদুর রহমান দিপু বলেন, ‘মার্জিন ঋণ আমার সঞ্চয়, পেনশন ও পরিবারের সুখ সব কেড়ে নিয়েছে। আমিও প্রথমে সঞ্চয়ের পাঁচ লাখ, পরে পেনশনের সাত লাখ টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করি। মাত্র দেড় মাসে ১২ লাখে মুনাফা হয় চার লাখ টাকা। লোভে পড়ে ২০১০ সালে ১১ লাখ টাকা ঋণ নেই। অক্টোবরে বিনিয়োগের পর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রকৃত বিনিয়োগ, মুনাফা আর মার্জিন ঋণের টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ লাখ। ২০১০ সালের ধসে সেই ২৮ লাখ নেমে আসে মাত্র তিন লাখে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কার্যালয় / ফাইল ছবি

‘লোকসানে পড়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পারিনি। পরিবারের খরচ কমাতে ঢাকার মতিঝিলের বাসা ছেড়ে এখন নারায়ণগঞ্জে থাকি। মনে অশান্তি, পরিবারেও অশান্তি।’ হতাশার সুরে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এরপর থেকে ঋণ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। ঋণ মানেই বিষ পান। গত এক যুগে সেই তিন লাখ টাকা এখন পাঁচ লাখে দাঁড়িয়েছে। যেদিন হারানো আসল তুলতে পারব, সেদিনই সালাম দিয়ে মার্কেট ছেড়ে দেব।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে লঙ্কা বাংলা সিকিউরিটিজের ট্রেডার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৯-১০ সালের দিকে মার্জিন ঋণ না দিলে হাউজে বিনিয়োগকারীরা থাকত না। অন্য হাউজে চলে যেত। চাকরি বাঁচানোর জন্য স্যারদের অনুরোধ করে মার্জিন ঋণ দিতে হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘মার্জিন ঋণ নিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী মুনাফা করেছেন। সেই মুনাফা তুলে যারা অন্য খাতে ব্যয় করেছেন তারাই গেইন হয়েছেন। কিন্তু যারা মার্কেটেই বিনিয়োগ করেছেন, তারা ধরা খেয়েছেন। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। গত এক যুগেও সেই ক্ষতি তারা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সাবেক সভাপতি ও ডিএসই পরিচালক শরীফ আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১০ সালে যেসব ব্রোকার হাউজ কম মার্জিন ঋণ দিয়েছে, তারাই কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁচতে হলে মার্জিন ঋণ পরিহার করতে হবে।

তিনি বলেন, বাজার ধসের কারণে গত ১০-১২ বছরে খরচ পোষাতে না পেরে শত শত শাখা অফিস বন্ধ হয়েছে। চাকরি হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ।

ডিবিএ’র বর্তমান সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফোর্সসেল বন্ধ করতে বিএসইসি এক অনুপাত এক (১ : ১) মার্জিন ঋণের বিধান চালু করেছে। আপাতত দৃষ্টিতে ফোর্সসেলের ক্ষতি থেকে বাঁচতে কমিশন এটি করেছে।

পুঁজি হারিয়ে রাজপথে বিক্ষোভ করছেন ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা / ছবি- সংগৃহীত

‘পুঁজিবাজারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি মার্জিন ঋণ ভালো নয়। আমি ঋণের বিপক্ষে’— উল্লেখ করে ডিবিএ সভাপতি বলেন, ‘একজন লোক ৫০ হাজার কিংবা এক লাখ টাকা আনল। তাকে পর দিন লোন দিয়ে দিলেন, এটা ঠিক নয়। তার ক্যাপাসিটি আছে কি না, দেখতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকলে তাকে লোন দেওয়া বন্ধ করতে হবে। কেউ যদি এ জাতীয় লোন দেন, অবশ্যই ক্লায়েন্ট বুঝে দিতে হবে। অপশন আছে বলেই যে লোন দিতে হবে, তা করা যাবে না। লোনের রেশিও কম হওয়া উচিত।’

‘আমি বিনিয়োগকারীদের অনুরোধ করব, আপনারা নিজের টাকায় শেয়ার কিনবেন। যদি কোনো কারণে মার্কেট নেমে যায় তাহলে অপেক্ষা করবেন। আর যদি ডিভিডেন্ড বেইজ শেয়ার কেনেন, কিছু দিন যদি অপেক্ষা করেন তাহলে দেখবেন ক্যাপিটাল সেভ থাকবে, গেইন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।’

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মার্জিন লোনের কারণে পুঁজিবাজারে বিতর্কিত ফোর্সসেলের জন্ম হয়। মার্জিন ঋণ ইনভেস্টমেন্টের জন্য নয়। বিশেষ করে যারা দুই লাখ, পাঁচ লাখ কিংবা ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে শেয়ার ব্যবসা করতে চান, তাদের জন্য তো নয়-ই।

মার্জিন ঋণ বাজারের জন্য সুখকর নয়— মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘এটা বাজার ও বিনিয়োগকারী সবাইকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এ কারণে আমাদের ১০৯টি মার্জিন অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে। এখন আমরা ভালো অবস্থানে আছি।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক ও সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী ঢাকা পোস্টকে বলনে, ঋণ করে কখনও পুঁজিবাজারে আসা উচিত নয়। স্ত্রীর গয়না, জমি কিংবা সম্পদ বিক্রি করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। কারণ, এখানে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ, লসের সম্ভাবনা রয়েছে।

‘২০১০ সালের ধসের পর মার্কেট ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, কেবল মার্জিন ঋণের কারণে। এর কারণে বাজারে ফোর্সসেল হয়, লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন। এখনও ছোট ছোট যত ধস হচ্ছে তা ফোর্সসেলের কারণে।’

বর্তমানে মার্জিন ঋণের অনুপাত ১ : ১। ফলে ব্রোকার হাউজগুলোর ফোর্সসেল কমেছে। মার্জিন ঋণের বিষয়ে বিএসইসি’র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদের ঋণ কখনও ভালো হয় না। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ সুতরাং মার্জিন ঋণ না নিয়ে বিনিয়োগ করাই উত্তম।’

এমআই/এমএআর/