অবশেষে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতির জট খুলছে। কয়েক দফা জ্যেষ্ঠতার তালিকা করেও নানা জটিলতায় শিক্ষকদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। সেই জট খুলে সহকারী শিক্ষক থেকে জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক পদে পদোন্নতির কার্যক্রম শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ পদে পদোন্নতি পেলে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হবেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা।  

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা গেজেটে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। সেখানে সহকারী শিক্ষকের মোট পদের ৫০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করার কথা বলা হয়েছে। এরপর সৃষ্ট পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া অনেকটাই গুছিয়ে এনেছিল মাউশি। ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর সহকারী শিক্ষকদের পদোন্নতি দিতে খসড়া গ্রেডেশন তালিকা প্রকাশ করে মাউশি।

তালিকায় ৫ হাজার ৮৫৪ জন শিক্ষকের নাম ছিল। তালিকায় অসঙ্গতি বা আপত্তি থাকলে ওই বছরের ১৪ নভেম্বরের মধ্যে আবেদন পাঠাতে বলা হয়েছিল শিক্ষকদের। কিন্তু নীতিমালা নিয়ে কতিপয় শিক্ষক আপত্তি তুললে আটকে যায় সে প্রক্রিয়া। পরে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিতে বিকল্প কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে শিক্ষকদের গ্রেডেশন তালিকা পাঠায় মাউশি।

সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির মতামতের ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক পদে পদোন্নতির জন্য জ্যেষ্ঠতা সমস্যা নিরসনে ২০১৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত মতামত দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিয়ে বলেছিল, কৃষি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা তাদের ১০ম গ্রেডে উন্নীত করার তারিখ অর্থাৎ ২০০৪ সালের ২২ মে থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু এটি চ্যালেঞ্জ করে কৃষি শিক্ষকেরা প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করলে পদোন্নতি আটকে যায়।

কারণ, বিশেষ প্রক্রিয়ায় ১৯৯৫ সালে ৩৭৮ জন কৃষি শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছিলেন ১৪তম গ্রেডে। তাই তারা সেসময় ১৪তম গ্রেডে বেতন পেতেন। আর অন্য শিক্ষকরা পেতেন ১০ম গ্রেডে বেতন।

গত বছরের শেষ দিকে আবার পদোন্নতির উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখন আরেক জটিলতা দেখা দেয়, যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কিছু শিক্ষককে পদোন্নতির তালিকাভুক্ত করার অভিযোগ ওঠে। 

নিয়মানুযায়ী জ্যেষ্ঠ শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারী শিক্ষক পদে অন্তত আট বছর চাকরি করতে হবে। আর সহকারী শিক্ষক পদে চাকরিতে প্রবেশের জন্য পাঁচ বছরের ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) বা ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (ডিপ ইন এডু) বা ব্যাচেলর অব এগ্রিকালচার এডুকেশন (বি এজ এডু) ডিগ্রি থাকতে হবে। নানা কারণে অনেক শিক্ষক এই শর্তটি নির্ধারিত সময়ে অর্জন করতে পারেননি। শর্ত অর্জন না করা এমন প্রায় দেড় হাজার শিক্ষককে পদোন্নতির তালিকাভুক্ত করে মাউশি। এতে অর্ধ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) শিক্ষকরা অভিযোগ করলে আটকে যায় পদোন্নতির প্রক্রিয়া।

তবে শিক্ষকদের তদবিরে ফের শুরু হয়েছে পদোন্নতির প্রক্রিয়া। একই সঙ্গে সহকারী প্রধান শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির উদ্যোগও নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুবু হোসেন বলেন, যেসব জটিলতা ছিল তা প্রায় গুছিয়ে আনা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক পদটি যেহেতু প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার পদ, এ পদে পদোন্নতি দিতে পিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) মতামত নিতে হয়। জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিতে পিএসসির মতামতের জন্য আমরা চিঠি পাঠিয়েছি। মতামত পেলে বিভাগীয় পদোন্নতি সভার (ডিপিসি) মাধ্যমে শিক্ষকদের পদোন্নতি দেওয়া হবে।

মাউশি সূত্র জানায়, সদ্য জাতীয়করণসহ সারাদেশে মোট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৮৭টি। এরমধ্যে পুরনো ৩৫১টি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে। এসব স্কুলে প্রধান শিক্ষকদের মোট ৩৫২টি পদের মধ্যে শূন্য আছে ২৩৬টি। আর সহকারী প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদের সংখ্যা ১০টি। 

এসব স্কুলের পাঁচ হাজার ৪৫২ জনকে সহকারী শিক্ষক থেকে জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আর প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির যোগ্য হিসেবে মাত্র তিন জন শিক্ষক ফিডার পদ পূর্ণ করেছেন। অন্যদিকে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির জন্য মোট শিক্ষকের ২০ শতাংশ পদ শূন্য হয়েছে। চাকরিবিধি অনুযায়ী সহকারী প্রধান শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক পদে ২০ শতাংশ সরাসরি পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর বাকি ৮০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়।

দীর্ঘদিন একই পদে চারি করা সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের কয়েকজন সহকারী শিক্ষক জানান, তাদের বঞ্চনার শেষ নেই। উপরের দিকে পদ না থাকায় সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করে এ পদেই অবসরে যেতে হচ্ছে তাদের অনেককে। আন্দোলনের পর জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক পদ সৃষ্টি হলেও নানা জটিলতায় সেই পদোন্নতি হচ্ছে না।

তারা জানান, ২০০৫ সালে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে যারা যোগদান করেছিলেন তাদের কেউই পদোন্নতি পাননি। বঞ্চিত হয়েছেন সিলেকশন গ্রেড থেকেও। ২০১৮ সালে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে এ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। দীর্ঘ চাকরি জীবনে একবারও পদোন্নতি ও সিলেকশন গ্রেড না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন তারা। 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহাব উদ্দীন মাহমুদ সালমী বলেন, একই পদে ৩০ বছর ধরে চাকির করে অনেকেই হতাশ। পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে তারা মানসিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত। দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক পদটি সৃষ্টি হলেও সেই পদে পদোন্নতি আটকে ছিল। জট খুলছে শুনে খুশি হলাম। আমরা চাই দ্রুত সময়ের মধ্যে এ পদোন্নতি দেওয়া হোক।

এদিকে, সহকারী প্রধান শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দিতেও প্রস্তাব পাঠাতে একাধিকবার মাউশিকে চিঠি দেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। সর্বশেষ ১৯ মে পাঠানো চিঠিতে প্রধান শিক্ষকের শুন্যপদে পদোন্নতি দিতে ডিপিসি সভা আয়োজন করতে শুন্যপদের সংখ্যা, পদোন্নতিযোগ্য ফিডারপদে কর্মরত সহকারী প্রধান শিক্ষকদের গ্রেডেশন তালিকাসহ সংশ্লিষ্ট সব তথ্য ২৭ মের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুবু হোসেন বলেন, মাউশি তিন জনের একটি তালিকা পাঠিয়েছিল। পদোন্নতিযোগ্য সব শিক্ষকের তালিকা চেয়ে মাউশিকে চিঠি দিয়েছি। এখন পর্যন্ত তথ্য পাইনি। তথ্য পেলে ডিপিসি সভা ডাকা হবে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাকরি বিধামালা অনুযায়ী ফিডার পদে পাঁচ বছর চাকরি করতে হয়। প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতিযোগ্য মাত্র তিন জন শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষক নেতরা দাবি করেছেন প্রধান শিক্ষকের শুন্যপদে পদোন্নতির। রাষ্ট্রপতির প্রমার্জন ছাড়া এক্ষেত্রে পদোন্নতির সুযোগ নেই।

এনএম/এইচকে/জেএস