বরিশালের ‘অভিরুচি’ সিনেমা হল

ধান-নদী-খালের জনপদ বরিশাল বিভাগে ঘরে ঘরে তখনও টেলিভিশন আসেনি। অ্যান্টেনাভিত্তিক বাংলাদেশ টেলিভিশনের সম্প্রচার দেখতে ছুটির দিনে ভিড় জমত গ্রাম্য মোড়লের উঠোনে-জানালায়। এছাড়াও বিনোদন প্রিয় মানুষগুলোর মন আঁকড়ে থাকত উপজেলা সদরের সিনেমা পাড়ায়।

ঘাটের কুলি থেকে চা দোকানি, কিংবা সরকারি অফিসের বড় কর্তার মুখে লেগে থাকত সিনেমার গল্প। নব্বই দশকের মাঝামাঝি তখন। রাজনীতি ও সিনেমার আলোচনা চলত সমানে-সমান। কে সমতা বা সুধী আসনে সিনেমা দেখে, কে সৌখিনে বা কে বিলাস আসনে এর ওপর সামাজিক মর্যাদাও বিবেচ্য হত।

প্রচণ্ড আবেগ আর ভালোবাসার স্থান ছিল প্রেক্ষাগৃহ। শত শত মানুষ হাসতে হাসতে ঢুকতেন প্রেক্ষাগৃহে। কিন্তু বিয়োগান্তক দৃশ্যে সিনেমা শেষ হলে কাঁদতে কাঁদতে বের হতেন। কিন্তু নানান কারণে অর্থনৈতিক পতনমুখ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে না পেরে বিলীন হয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের সিনেমা হলগুলো।

‘অভিরুচি’ সিনেমা হল

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র বুকিং এজেন্ট জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, দেশে বর্তমানে সিনেমা হল রয়েছে ২০০টি। এরমধ্যে চালু ৬০টি। সেই তালিকায় বরিশাল বিভাগে আছে মাত্র ৪টি! খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর দেড় কিলোমিটারের মধ্যে ছিল ‘সোনালী’, ‘বিউটি’, ‘কাকলী’ ও ‘অভিরুচি’ সিনেমা হল। এরমধ্যে ‘অভিরুচি’ বাদে বাকি তিনটি ভেঙে গড়ে তোলা হয়েছে বহুতল ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, ঝালকাঠিসহ ৬ জেলার ৪২ উপজেলায় আশির দশকে ১০৪টি প্রেক্ষাগৃহ ছিল। নব্বইয়ের দশকে যা কমে ৫০টিতে নেমে আসে। সর্বশেষ দুই দশকের পালাবদলে এখন মাত্র ৬টি প্রেক্ষাগৃহের বাতি জ্বলছে নিভু নিভু করে। 

এরমধ্যে ৪টি নিয়মিত সিনেমা প্রদর্শন করে। বাকি দুটিতে বিশেষ দিবস উপলক্ষে পর্দায় আলো পড়ে। বরিশালে ‘অভিরুচি’, ভোলায় ‘রূপসী’, পটুয়াখালীতে ‘তিতাস’ ও বোরহানউদ্দিনে ‘রাজমনি’ নিয়মিত সিনেমা প্রদর্শন করে। এছাড়া পটুয়াখালীর বাউফলের ‘বৈশাখী’, ভোলার ‘অবসর’ সিনেমা দুই ঈদে চালু করা হয়। 

‘সিনেমা হল অনেকের জীবন গড়েছে, অনেককে পথে বসিয়েছে। এখন আমরা যারা সিনেমা হল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তারা পথে বসেছি’ কথাগুলো বলছিলেন বরিশাল বিভাগের বিলাসবহুল ‘অভিরুচি’ সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক সৈয়দ রেজাউল করিম।

রেজাউল করিম আরও বলেন, ‘সিনেমা হল এখন অতীত ইতিহাস। এই শিল্প আর কখনও দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। আমরা লোকসান গুনে এখনও চালিয়ে রেখেছি শুধু পুরোনো খ্যাতির কারণে। দশ বছর আগেও ‘অভিরুচি’র আসন সংখ্যা ছিল ১২০০। দর্শকের অভাবে তা কমিয়ে এখন ৩৫০ করা হয়েছে। বিগত পাঁচ বছরে কোনদিন সেই আসনও পূর্ণ হয়নি।’

রেজাউল করিমের অভিযোগ, দেশীয় নির্মাতাদের উদাসীনতা ও মানহীন সিনেমার কারণে বিলীন হয়ে গেছে প্রেক্ষাগৃহ। বর্তমান চিত্র তুলে ধরে তিনি জানান, ১৪ ফেব্রুয়ারি (রোববার) মর্নিং শোতে ৩ জন, ম্যাটিনিতে ৭ জন দর্শক হয়েছে। নাইট শো বন্ধ রাখা হয়েছে। হলের স্টাফ একেবারেই কমিয়ে ফেলা হয়েছে। আগে ২৫ জন ছিল বেতনভুক্ত। এছাড়াও কাজ করতেন কমপক্ষে ৭০-৮০ জন। টিকিট বিক্রি করেই তাদের জীবন চলত। 

৮৫০ আসন নিয়ে এখনও নিয়মিত সিনেমা দেখিয়ে যাচ্ছে ভোলার ‘রূপসী’ সিনেমা’। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রতিটি প্রদর্শনীতে দর্শক সংখ্যা মাত্র ৩ থেকে ৫ জন! হলের মালিক আমিরুল ইসলাম কচি বলেন, ‘সিনেমা শিল্প বাঁচিয়ে রাখার জন্য কারও কোনো মাথাব্যাথা নেই। হচ্ছে না ভালো মানের সিনেমা। এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাও দেখা যায় না। তাছাড়া শিল্পী মালিক সমিতির অভ্যন্তরীণ রাজনীতির শিকার হয়ে চলচ্চিত্র জগতই নষ্ট হয়ে গেছে। সামনের রমজান পর্যন্ত হল খোলা রাখব। নূন্যতম ভালো সিনেমা না এলে, দর্শক হলে না ফিরলে হল বন্ধ করে দেব।’

আমিরুল ইসলাম কচি অভিযোগ করে বলেন, ‘করোনার সময় আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল হল মালিকদের অনুদান দেওয়া হবে। কোথায় কি? কেউ একদিন খবরও নেয়নি। এই হলে কয়েক বছর আগেও প্রতিদিন চারটি শো হতো। অথচ এখন দুটি প্রদর্শনীর খরচই তোলা যায় না। সার্বিক হিসেবে দিনে খরচ হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। হলের আয় হয় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা।’

‘তিতাস’সিনেমা হল

২০০৪ সালে চরফ্যাশন উপজেলার শশীভূষণ থানার আলোচিত ‘রঙিলা’ হলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হল মালিক মাইনুদ্দিন জমাদার বলেন, ‘নিম্নমানের সিনেমা নির্মাণ হতে দেখেই হলটি বন্ধ করে দেই। একদিন দুইদিন লোকসান দেওয়া যায়, বছরের পর বছর তো সম্ভব না।’

জানা গেছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে বরিশাল বিভাগের অধিকাংশ সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতীয় সিনেমার নকল, অশ্লীল চিত্রধারণ, গল্পহীনতা ও সৃষ্টিশীলতা না থাকায় এমন অবস্থা বলে মনে করেন হল মালিকরা। ঝালকাঠির বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘মিতু’ সিনেমা হলের মালিক জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে দর্শকশূন্য হয়ে গেছে সিনেমা হল। তাই লোকসান দিয়ে আর চালাইনি। বন্ধ করে দিয়েছি।’ 

হল মালিকের দাবি, সিনেমা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারলে জাতীয় আয়ের বড় অংশ এই শিল্প থেকে অর্জন করা সম্ভব। এজন্য দরকার পরিকল্পনা। প্রয়োজন সিনেমা শিল্পে সমৃদ্ধ দেশের সঙ্গে বিনিময় চুক্তি। এছাড়াও কপিরাইট আইন কঠোর করা। নকল সিনেমা যেন না চালাতে পারে সেজন্য সেন্সর বোর্ডকে শক্তিশালী করতে হবে।

বরিশাল বিভাগে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাকি ৪৪টি প্রেক্ষাগৃহের বর্তমান চিত্র: 
বহুতল ব্যবসায়ীক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে বরিশাল শহরের ‘কাকলী’, ‘বিউটি’, ‘সোনালী’, উজিরপুরের  ‘স্বপ্নপুরী’, গৌরনদীর ‘শতাব্দী’ ও ‘নাহার’, ঝালকাঠি জেলা সদরের ‘রূপালী’ ও ‘পলাশ’, মঠবাড়িয়া উপজেলার ‘মুন্নী’, বাউফলের ‘আনন্দ’, ‘স্বপন’ ও ‘সুন্দরী’ এবং লালমোহন উপজেলার ‘মধুছন্দা’ সিনেমা হল।

পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে পাথারঘাটা উপজেলার ‘টিটু’ ও ‘সোনি’, মঠবাড়িয়ার ‘আলিম’, বাকেরগঞ্জের ‘সংগীতা’, পাথরঘাটার কাকচিরা ইউনিয়নের ‘মিতু’, ঝালকাঠি জেলা সদরের ‘মিতু’, কাউখালী উপজেলার ‘নাদিম’ সিনেমা ও বানারীপাড়া উপজেলার ‘সোনিয়া’ সিনেমা হল।

খাদ্যগুদাম করা হয়েছে আমুয়া বন্দরের ‘অলংকার’, ইন্দেরহাটের ‘সন্ধ্যাবাণী’, কলাপাড়ার ‘আলিম’ সিনেমা হল রূপান্তর করা হয়েছে কমিউনিটি সেন্টারে।

সিনেমা হলের স্থানে ভবন নির্মান করে বসবাসের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি ইউনিয়নের ‘ঘোমটা’ ও ‘রংধনু’, কলাপাড়া উপজেলার ‘সোসাইটি’, কাউখালী উপজেলার ‘পলাশ’, মুলাদী উপজেলার ‘মিতু’, কাঁঠালিয়ার ‘মুন’, পটুয়াখালীর আলীপুরে ‘সোহেলা’, মহিপুরে ‘সাগর’ ও ‘নুপুর’, আমতলী উপজেলার ‘লাভলু’, ভান্ডারিয়ার ‘রূপা’, বামনা উপজেলার ‘আশা’, চরফ্যাশনের ‘সবুজ’, ‘সাগরী’, ‘ফ্যাশন’, নলছিটি উপজেলার ‘আন্নিকা’, বরগুনা জেলা সদরের ‘শ্যামলী’ ও ‘সোনিয়া’, শশীভূষণের ‘রঙিলা’, দক্ষিণ আইচার ‘সাগরিকা’ এবং দুলারহাটের ‘দুলারী’ সিনেমা হলে।  

এমআরএম/আরআইজে