ছোট-বড় নানা ঘটনায় বছরজুড়ে উত্তাপ ছিল রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল- সড়ক দুর্ঘটনায় তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু, হাফ ভাড়া ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের মারধর, প্রতিবাদে বাস আটক, সড়ক অবরোধ করে হাফ ভাড়া বাস্তবায়নের আন্দোলন, ছাত্রলীগের কমিটির দাবিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন নেতার গাড়িবহর অবরোধ।

এছাড়া তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিউমার্কেটে শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে টানা ৭২ ঘণ্টার অচলাবস্থা টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছিল।  

অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে চলতি বছরেই কলেজ জুড়ে স্থাপন করা হয়েছে ৭৫টি সিসিটিভি ক্যামেরা। করোনার সংক্রমণে দীর্ঘ বন্ধের ফলে সৃষ্ট সেশনজট কাটাতে ২০২২ সাল জুড়ে নেওয়া হয় নানা পরিকল্পনা।  

বছরের শুরুতে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ওমিক্রনের চোখ রাঙানি
২০২২ সালের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে পুরো ক্যাম্পাসে ৭৫টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল। ২-১০ জানুয়ারির মধ্যে স্থাপন করা হয় এসব ক্যামেরা। ঢাকা কলেজের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছিল স্থানীয় থানা পুলিশও। কারণ বৈদ্যুতিক তার চুরি, কলেজের সামনের সড়কে ছিনতাইসহ বেশ কয়েকটি ঘটনায় কলেজের সিটিটিভি ফুটেজ দেখে অপরাধীকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

বছরের শুরুতেই নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষাসহ অন্যান্য কার্যক্রম সচল হলেও ফের ছন্দপতন ঘটায় করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’। করোনার নতুন এ ধরন রোধে জানুয়ারির ২১ তারিখ থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

নির্দেশনা অনুযায়ী বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা কলেজের ক্লাস। এমন অবস্থায় পুনরায় পুরোদমে অনলাইন ক্লাসে ফিরে যায় ঢাকা কলেজ। করোনা দুর্যোগ বিবেচনায় এসব অনলাইন ক্লাস সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় যেন প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষার্থীরাও এর মাধ্যমে উপকৃত হতে পারেন।

প্রথমবারের মতো উচ্চ মাধ্যমিকের ৩৩২ শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা
কলেজের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২৭ জানুয়ারি সংবর্ধনা দেওয়া হয় বুয়েট মেডিকেলসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সপ্রাপ্ত ৩৩২ মেধাবী শিক্ষার্থীকে। যারা সবাই ঢাকা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০২২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ৫৩ জন, বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০ জন, বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ৩২ জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৮ জন, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৯ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। এ কৃতি শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতেই এমন উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা কলেজ।

ফেব্রুয়ারি-মার্চে হাফ ভাড়া বিতণ্ডার উত্তাপ
গণপরিবহনে হাফ ভাড়া দেওয়াকে কেন্দ্র করে পরিবহন শ্রমিকদের সাথে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের বিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। এর জেরে শিক্ষার্থীদের মারধরও করা হয়। যার প্রতিবাদে বাস আটক করে শিক্ষার্থীরা। এসব ঘটনার জেরে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে উত্তপ্ত ছিল কলেজ।

ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটির জেরে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় ৭ ফেব্রুয়ারি মৌমিতা ট্রান্সপোর্টের দুই বাস আটক করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি এমনই আরেক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সেদিন হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় ঢাকা কলেজের তিন শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধর করেন মিরপুর মেট্রো সার্ভিসের পরিবহন শ্রমিকরা। এ ঘটনার জেরে ওই পরিবহনের ৯টি বাস আটক রাখেন শিক্ষার্থীরা।

মার্চ মাসেও ঘটে এমন অনেক ছোট-বড় ঘটনা। এরপর সমস্যা সমাধানে স্থানীয় থানার পুলিশ প্রশাসন, কলেজ প্রশাসন এবং পরিবহন মালিকদের মধ্যে সমন্বয়ে বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।

সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ যায় তিন শিক্ষার্থীর
৬ মার্চ সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটের দিকে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম এলাকায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ঢাকা কলেজের এহসানুল ইসলাম রিজভী নামের এক শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। তিনি কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছিলেন। এরপর ঈদের দিন ৪ মে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কলেজেরই আরেক শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমান শান্ত। তিনি ঢাকা কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের সম্মান চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস ছাত্রাবাসের ১০৩ নম্বর কক্ষে।

সবশেষ গত ৫ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ে সড়কে প্রাইভেটকারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মো. সাবাব আজাদ (২১) নামের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়।

দুর্ঘটনায় তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু ছাড়াও অসুস্থ হয়ে মারা যান একজন শিক্ষকও। পহেলা অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সনজিদা আক্তার ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৭ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি লিভার সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছিলেন। তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন।

৭৪তম অধ্যক্ষের অবসর, নতুন অধ্যক্ষের যোগদান
দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের ইতি টেনে চলতি বছরের ২৪ মার্চ অবসরে যান ঢাকা কলেজের ৭৪তম অধ্যক্ষ অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার। এর মধ্য দিয়ে টানা ৩২ বছরের শিক্ষকতা জীবন শেষ করেন তিনি। এর প্রায় চার মাস পর নতুন অধ্যক্ষ পায় ঢাকা কলেজ। ৭৬তম অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন হন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ। এর মাঝে ৭৫তম অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক এ.টি.এম. মইনুল হোসেন।

বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ী সংঘর্ষ
চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হয় ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী ও নিউমার্কেট ব্যবসায়ীদের মধ্যকার সংঘর্ষের খবর। মূলত নিউমার্কেটের ভেতর দোকান বসানোকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। 

সেই ঘটনার জেরেই শুরু হয় সংঘর্ষ যা পরবর্তীতে ৭২ ঘণ্টার অচলাবস্থা তৈরি করে। এ ঘটনায় ১৯ এপ্রিল রাত ১২টা থেকে ভোর ৩টা ও সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে ব্যবসায়ীদের ছোঁড়া ইট পাটকেল ও পুলিশের টিয়ারগ্যাসের আঘাতে ঢাকা কলেজের তিনশ'র অধিক শিক্ষার্থী আহত হন।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় কলেজ ও ছাত্রাবাস। তবে বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।  পরে এসব ঘটনার জেরে পুলিশের ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট ডিসি, এডিসি, ও নিউমার্কেট থানার ওসির প্রত্যাহারসহ ১০ দফা দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।

ছাত্রলীগের কমিটির অপেক্ষায় বছর শেষ
দীর্ঘ ছয় বছর ধরে কমিটিবিহীন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগে গতিতে ফেরাতে পারেননি জয়-লেখকও। দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থাকার পরও নেতাকর্মীদের হতাশ করেছেন তারা। ‘শিগগিরই কমিটির ঘোষণা আসছে’, ‘সামনের মাসেই কমিটি’, ‘নেতৃবৃন্দ যাচাই-বাছাই চলছে’, ‘কমিটি দেওয়ার মাধ্যমে নেতৃত্বশূন্যতা দূর করা হবে’- অসংখ্যবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এমন আশার বাণী শোনালেও ফলাফল ছিল শূন্যই।

কলেজ ছাত্রলীগের সিনিয়র-জুনিয়র অসংখ্য নেতাকর্মীকে কমিটির আশ্বাস দিয়েও পিছু হটেছেন তারা। তবে বছর জুড়েই ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রতীক্ষায় ছিলেন কমিটির।

শেষ সময়ে অবরুদ্ধ জয়-লেখক
৪ ডিসেম্বর কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার দাবিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়কে অবরুদ্ধ করেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ওইদিন রাত সাড়ে ১০টায় নিউমার্কেট এলাকায় জয়ের গাড়িবহর আটকে দেন বিক্ষুব্ধ কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

তবে অবরুদ্ধ থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন জয়। একই সময়ে লেখক ভট্টাচার্যের বাসার সামনেও কমিটির দাবিতে অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে রাত ১১টার দিকে মিরপুর রোডের সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে নীলক্ষেত অভিমুখের সড়কে কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকশ নেতাকর্মী অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এতে করে মুহূর্তেই সব যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

অবরোধের মুখে পড়েন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও
কমিটির দাবিতে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় অবরোধের মুখে পড়েন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হকের গাড়িবহর।

অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে কমিটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে- নেতাদের মুখে এমন আশ্বাসের পর সড়ক অবরোধ তুলে নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তবে শেষ পর্যন্ত এ বছরও আর কমিটির মুখ দেখা হলো না ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের। 

আরএইচটি/এমজে/এনএফ