সব হিসাব পাওয়া গেলে ‘নয়-ছয়’ হওয়া টাকার পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে— মনে করছেন ওয়াসা সংশ্লিষ্টরা / ছবি- ঢাকা পোস্ট

• ১০ বছরে গরমিল টাকার পরিমাণ হাজার কোটি
• ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ ব্যবস্থাপনা কমিটি
• বিচারের আশায় আদালত-দুদকে সমিতির নেতারা
 
রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের মধ্যে চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী পিপিআই (প্রোগ্রাম ফর পারফরমেন্স ইমপ্রুভমেন্ট) কার্যক্রমের আওতায় ঢাকা ওয়াসার বিলিং ও মিটার কার্যক্রম শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল, ঢাকা ওয়াসার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার পাশাপাশি সমিতি যেন স্বাবলম্বী হয়।

চুক্তি অনুযায়ী সমিতির অনুকূলে কর্মচারীরা বিলিংবাবদ ৬ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন পান। কমিশনের ওই টাকা জমা হয় সমিতির নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। অথচ সেই টাকা নয়-ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা জেলা সমবায় অফিসের নিজস্ব নিরীক্ষা (অডিট) প্রতিবেদনে দুই অর্থবছরে প্রায় ১৭৬ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে সমবায় অফিসের নিরীক্ষা দলের দুই বছরের হিসাব পর্যালোচনার পাশাপাশি পাওয়া অন্যান্য নথিপত্রে প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকার অসঙ্গতির তথ্য মিলেছে।

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে দুর্নীতি ও লুটপাটের প্রকৃত চিত্র নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বের হয়ে আসেনি। তবে, বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের আরও নমুনা পাওয়ায় বর্তমানে ১০ বছরের হিসাব পর্যালোচনায় বিভাগীয় পর্যায়ে নিরীক্ষা (অডিট) কার্যক্রম চলছে। সব হিসাব পাওয়া গেলে টাকার পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে— মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা পোস্টের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং সমিতির সিনিয়র সদস্য ও নিরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্যেও অর্থ নয়-ছয়ের তথ্য উঠে এসেছে।

আরও পড়ুন >> যুক্তরাষ্ট্রে তাকসিমের ১৪ বাড়ির খোঁজে নেমেছে দুদক

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে অন্তর্বর্তীকালীন পিপিআই পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান মো. আক্তারুজ্জামান ও কো-চেয়ারম্যান মিঞা মো. মিজানুর রহমানের যৌথ স্বাক্ষরে সমিতির/পিপিআই প্রকল্পের ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হয়েছে। ওই সময়ে ঢাকা ওয়াসা থেকে কমিশন হিসাবে পাওয়া ১৩২ কোটি চার লাখ টাকা এবং বিধিবহির্ভূত ব্যয় হিসাবে প্রায় সাড়ে ৪৪ কোটি টাকার হিসাব পাওয়া যায়নি। অর্থ আত্মসাতের আরও নমুনা পাওয়ায় বর্তমানে ১০ বছরের হিসাব পর্যালোচনায় বিভাগীয় পর্যায়ে চলছে নিরীক্ষা কার্যক্রম।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে ওয়াসা থেকে ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা কমিশন পেলেও সমিতির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের হিসাববিবরণীতে মাত্র এক কোটি ৭৯ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৩ টাকা দেখানো হয়। অর্থাৎ নিরীক্ষা দল ৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭০ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা হতে প্রাপ্ত ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকার হদিস পাননি। এ অর্থ কোথায় এবং কীভাবে ব্যয় হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছ থেকে পাওয়া যায়নি

এ বিষয়ে নিরীক্ষা দলের প্রধান ও ঢাকা জেলা মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কর্মকর্তা রেজাউল বারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অডিট প্রতিবেদনে ১৩২ কোটি চার লাখ ও ৪৪ কোটি ২১ লাখ টাকা আত্মসাৎ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি গাড়ি ব্যবহারসহ বেশকিছু অভিযোগ আনা হয়েছে। সমবায় সমিতি আইন ৪৯ এর (১) ও (৫) ধারায় তদন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। ওই ধারায় সাজা ও জরিমানার বিধান রয়েছে। সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত এখনও চলমান। ১০ বছরের রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই করা হবে।

১৩২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের নেতৃবৃন্দের সংবাদ সম্মেলন / ঢাকা পোস্ট

‘আমি মাত্র দুই বছরের অডিট করেছিলাম। ওই সময়ে আক্তারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাপনা কমিটি দায়িত্বে ছিল। অডিট (নিরীক্ষা) চলাকালীন আমি ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাইনি। তদন্তের সময় আমরা হাজার কোটি টাকার একটি (পিপিআই ফান্ড) তথ্য পেয়েছি। পুরো ফান্ডের (তহবিল) কী অবস্থা, সে বিষয়ে রেকর্ডপত্র বা অস্তিত্ব খুঁজে পাইনি। এ কারণে অডিট টিম তদন্তের সুপারিশ করেছিল।’

যার বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগে তির সমিতির সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ও পিপিআই প্রকল্প পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যে সময়ের কথা বলছেন, সেই সময়ে আমি দায়িত্বে ছিলাম। তবে, এর আগেও বিভিন্ন জন দায়িত্বে ছিলেন। এ বিষয়ে এখন আমার বক্তব্য দেওয়া সঠিক হবে না। অফিসিয়াল অনুমতি ছাড়া আমি কোনো বক্তব্য দিতে পারব না।’

তেজগাঁও মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী ও ঢাকা জেলা সমবায় কার্যালয়ের কর্মকর্তা মঞ্জুরুল কবীরের নেতৃত্বাধীন নিরীক্ষা দল প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দেন ২০২১ সালের ৩০ জুন। প্রতিবেদনে সমিতির হিসাব ‘নয়-ছয়’ করাসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তির অবৈধ ভোগ-দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে।

এ বিষয় নিরীক্ষা কাজে সম্পৃক্ত এবং ওয়াসার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওয়াসার সঙ্গে পিপিআই প্রকল্পের কাজ একটি জোন দিয়ে শুরু। এরপর ছয়টি জোনে পিপিআই প্রকল্পের অধীনে কাজ হয়। মিটার রিডিং ও বিল আদায়ের পর প্রতি মাসে কমিশনবাবদ একটি অংশ (অর্থ) ওয়াসা বহুমুখী সমবায় সমিতির হিসাবে জমা হয়। এমন ছয়টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করলে গরমিল পাওয়া যায়। হিসাবগুলো হলো- জনতা ব্যাংক, কারওয়ান বাজার কর্পোরেট শাখার দুটি হিসাব; প্রিমিয়ার ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও ওয়ান ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখা এবং সাউথ ইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ধানমন্ডি শাখা।

আরও পড়ুন >> ‘নির্দেশনা’ পেয়ে তাকসিমের পাশে দাঁড়াতে আসেন তারা!

এসব শাখায় থাকা হিসাবের তথ্য নিরীক্ষা দল যাচাই-বাছাই করেছে। এর পেছনে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। আমি মনে করি, বিগত ১০ বছরের সব হিসাববিবরণী আইন ও বিধি অনুসারে খতিয়ে দেখলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। শুধু আত্মসাৎ নয়, আরও অনেক বিষয় রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানে যা হওয়া উচিত নয়। ‘শক্তিশালী সিন্ডিকেটে কারা রয়েছেন’ — জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।

বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের আরও নমুনা পাওয়ায় বর্তমানে ১০ বছরের হিসাব পর্যালোচনায় বিভাগীয় পর্যায়ে নিরীক্ষা (অডিট) কার্যক্রম চলছে। সব হিসাব পাওয়া গেলে টাকার পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে— মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যা আছে

চুক্তি অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে বিলিংবাবদ বাস্তবায়নকারী সংস্থার অনুকূলে প্রদত্ত কমিশনের হার ছিল ৬ শতাংশ। যা পরে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এ কার্যক্রমে নিয়োজিত ওয়াসার কর্মচারীরা বেতন-ভাতাদির পাশাপাশি তাদের পারফরমেন্সের ভিত্তিতে অতিরিক্ত ভাতা পান। প্রথম পর্যায়ে পিপিআই প্রকল্পের আওতায় সমবায় সমিতির নামে একটি জোন বরাদ্দ নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি জোন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব কার্যক্রম ঢাকা ওয়াসা হতে একজন পিডি (প্রকল্প পরিচালক) ও দুজন কো-পিডি, অন্যদিকে সমবায় সমিতির মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ থেকে একজন চেয়ারম্যান, তিনজন কো-চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সমিতির সাবেক সভাপতি ও পিপিআই প্রকল্প পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী আক্তারুজ্জামানের বিরুদ্ধে / ঢাকা পোস্ট

২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবে দফায় দফায় ১৭৮ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ছয় টাকা কমিশন হিসাবে জমা হয়। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সমিতির নামে মোট ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকা কমিশনবাবদ ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ওয়াসা থেকে ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা কমিশন পেলেও সমিতির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের হিসাববিবরণীতে মাত্র এক কোটি ৭৯ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৩ টাকা দেখানো হয়। অর্থাৎ নিরীক্ষা দল ৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭০ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা হতে প্রাপ্ত ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকার হদিস পাননি। এ অর্থ কোথায় এবং কীভাবে ব্যয় হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সমিতির সভাপতি ও পিপিআই প্রকল্প পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. হাফিজ উদ্দিন ও প্রকল্প পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান মিঞা মো. মিজানুর রহমানের যৌথ স্বাক্ষরে পিপিআই প্রকল্পের সব ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হতো। কিন্তু পিপিআই পরিচালনা কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন অসুস্থ থাকায় সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মোতাবেক সমিতির সদস্য ও ঢাকা ওয়াসার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামানকে অন্তর্বর্তীকালীন পিপিআই পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদের যৌথ স্বাক্ষরেই পিপিআই প্রকল্পের ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হয়। এ বিষয়ে আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু নিরীক্ষা দলকে কোনো তথ্য দেননি তিনি।

আরও পড়ুন >> একটা টাকাও অসৎ উপায়ে উপার্জন করিনি : তাকসিম এ খান

নিরীক্ষার সময় সমিতির নামে থাকা ছয়টি ব্যাংক হিসাবের লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১০ মার্চ নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি ও ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে দায়িত্বপালনকারী সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি ব্যাংক লেনদেন করেছে। ওই ব্যাংক হিসাব থেকে ৪৪ কোটি ২১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৩ টাকা তোলা হলেও ওই টাকার হিসাব নিরীক্ষার সময় পাওয়া যায়নি। নিরীক্ষা দলের কাছে ওই ব্যবস্থাপনা কমিটি সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।

প্রকল্পে ব্যবহৃত সমিতির অর্থে কেনা প্রাইভেট কার ও লেগুনাসহ মোট ২৫ টি গাড়ির মধ্যে ২৪টি ঢাকা ওয়াসা ২০১৮ সাল থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে দখলে নিয়ে ব্যবহার করছে। গাড়িগুলোর মধ্যে একটি টয়োটা প্রাইভেট কার পিপিআই প্রকল্পের চেয়ারম্যান হিসেবে মো. আক্তারুজ্জামান ব্যবহার করছেন। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনের পর বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও আক্তারুজ্জামান গাড়িটি হস্তান্তর করেননি

নিরীক্ষার সময় আরও দেখা যায়, প্রকল্পে ব্যবহৃত সমিতির অর্থে কেনা প্রাইভেট কার ও লেগুনাসহ মোট ২৫ টি গাড়ির মধ্যে ২৪টি ঢাকা ওয়াসা ২০১৮ সাল থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে দখলে নিয়ে ব্যবহার করছে। গাড়িগুলোর মধ্যে একটি টয়োটা প্রাইভেট কার (রেজি. নং- ঢাকা গ ১৭- ৩৬৭৭) পিপিআই প্রকল্পের চেয়ারম্যান হিসেবে মো. আক্তারুজ্জামান ব্যবহার করছেন। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনের পর বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও আক্তারুজ্জামান গাড়িটি হস্তান্তর করেননি। নিরীক্ষার সময় গাড়িটির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি সন্তোষজনক জবাবও দিতে পারেননি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সুপারিশে যা আছে
 
নিরীক্ষাকালে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সরবরাহ করা সমিতির নামীয় ব্যাংক হিসাববিবরণী এবং ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন তথ্য ও হিসাববিবরণী পর্যালোচনা করে অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা গেছে। যার মধ্যে রয়েছে, সমবায় সমিতি আইন ২০০১ (সংশোধিত, ২০০২ ও ২০১৩) এর ১৭ ধারা অনুযায়ী বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিগত ব্যবস্থাপনা কমিটি সমিতির নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা করেনি। বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও বিগত ব্যবস্থাপনা কমিটি তাদের সময়ের হিসাববিবরণীসহ সমিতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্র অদ্যাবধি সমিতির বর্তমান নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছেও বুঝিয়ে দেয়নি।

প্রতিবেদনে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিমের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনা না হলেও সমিতির অধিকাংশ সদস্যের মতে এ অনিয়মের পেছনের কারিগর ‘এমডি’ সিন্ডিকেট / ঢাকা পোস্ট

আক্তারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাপনা কমিটি দায়িত্বপালনের সময় অর্থাৎ সমিতির ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাববিবরণী নিরীক্ষা দলের কাছে সরবরাহ করেননি।

ঢাকা ওয়াসার আউটসোর্স রাজস্ব জোনের রাজস্ব আদায়ের জন্য পিপিআই নামীয় প্রকল্পে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে মোট ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকা কমিশনবাবদ ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ওয়াসা থেকে ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা কমিশন পেলেও সমিতির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের হিসাববিবরণীতে মাত্র এক  কোটি ৭৯ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৩ টাকা দেখানো হয়। অর্থাৎ বাকি ৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭০ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা থেকে পাওয়া ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকা কোথায় ও কীভাবে ব্যয় হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ১৩২ কোটি চার লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টাকার কোনো হিসাব নিরীক্ষাকালে না পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন >> তাকসিমের যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ বাড়ি: অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান হাইকোর্ট

পিপিআই প্রকল্প থেকে পাওয়া আয় সমিতির হিসাবে হিসাবভুক্ত না করে সমিতির সংশ্লিষ্ট সময়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসহ ওই প্রকল্পের পরিচালনাপর্ষদের সদস্যগণ বিধিবহির্ভূত ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যয় করেছেন। এছাড়া ২০১৬ সালের ১০ মার্চ নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি ও ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে দায়িত্বপালনকারী সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি ৪৪ কোটি ২১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৩ টাকা তোলেন। ওই টাকার হিসাবও নিরীক্ষাকালে পাওয়া যায়নি।

পিপিআই প্রকল্পের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পুনরায় চুক্তি নবায়ন না করে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে সমিতির অর্থায়নে ক্রয় করা সম্পদ- অফিস সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র, মোট ৬২ হাজার ৪৮১টি পানির মিটার ও মিটারের যন্ত্রাংশ, প্রাইভেট কার ও লেগুনাসহ মোট ২৪টি গাড়ি বিধিবহির্ভূত ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে দখলে নিয়ে ব্যবহার করেছে। এছাড়া পিপিআই প্রকল্পের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে ঢাকা ওয়াসার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান সমিতির টয়োটা প্রাইভেট কারটিও হস্তান্তর করেননি।

এসব কারণে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত দায়ীদের বিরুদ্ধে সমবায় সমিতি আইন- ২০০১ (সংশোধিত- ২০০২ ও ২০১৩) এর ৪৯ (১) ও (৫) ধারায় তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করে নিরীক্ষা দল। তারা ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রতিবেদন জমা দেয়।

সব হিসাব পাওয়া গেলে আত্মসাৎ করা টাকার পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে— মনে করছেন ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির সদস্যরা / ঢাকা পোস্ট

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনা না হলেও সমিতির অধিকাংশ সদস্যদের মতে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির পেছনের কারিগর ‘এমডি’ সিন্ডিকেট। যে কারণে ২০২২ সালের ২৩ জুন ১৩২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিমসহ নয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির সম্পাদক মো. শাহাব উদ্দিন সরকার। কিন্তু বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ না করে মামলার আবেদনটি ফেরত দেন আদালত। একই সঙ্গে দুদকের এখতিয়ারভুক্ত হওয়ায় সেখানে দাখিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যার ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধানে নেমেছে।

এ বিষয়ে জানতে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আদালতে দাখিল করা আবেদনে যা বলা হয়েছে

ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে ২০২২ সালের ২৩ জুন ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির পক্ষে এ সংক্রান্ত মামলার আবেদন করেন সমিতির সম্পাদক মো. শাহাব উদ্দিন সরকার। কিন্তু বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ না করে মামলার আবেদনটি ফেরত দেন আদালত। যেখানে এমডি তাকসিম এ খান ছাড়াও আসামি করা হয় ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী শারমিন হক আমীর, সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক মিঞা মো. মিজানুর রহমান, প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান, রাজস্ব পরিদর্শক জাকির হোসেন, প্রকৌশলী বদরুল আলম, জনতা ব্যাংকের সাবেক ডিজিএম শ্যামল বিশ্বাস, উপ-সচিব শেখ এনায়েত উল্লাহ ও উপপ্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সালেকুর রহমান। এছাড়া অজ্ঞাত পরিচয়েও আসামি করা হয়।

আরও পড়ুন >> ১৩ বছরে ৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বেতন নিয়েছেন ওয়াসার তাকসিম

ওই মামলার আবেদনে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা ঢাকা ওয়াসা থেকে রাজস্ব আদায়বাবদ পায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একই কাজবাবদ সমিতি আয় করে ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকা। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সমিতির হিসাবে জমা হয় এক কোটি ৭৯ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৩ টাকা। অবশিষ্ট ১৩২ কোটি চার লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টাকা ছয়টি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে এমডি তাকসিম এ খানের প্রত্যক্ষ মদদ ও নির্দেশে অপর আসামিরা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন।

আসামিদের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি সমবায় অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে। এছাড়া সমিতির গাড়িসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সমিতির হেফাজত থেকে স্থানান্তর করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ চুরি করা হয়েছে। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে বিশ্বাসভঙ্গ করে অর্থ আত্মসাৎ ও চুরি করেছেন বলে অভিযোগ আনেন বাদী। মামলাটি আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি অথবা পিবিআইকে তদন্ত করে আসামিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানান বাদী শাহাব উদ্দিন সরকার।

 টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। ইতোমধ্যে সমিতির সাবেক ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ, নিরীক্ষা দলের সদস্যসহ ডজনখানেক ব্যক্তির বক্তব্য নিয়েছে তারা / ঢাকা পোস্ট

শাহাব উদ্দিন এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যাদের নামে অভিযোগ করেছি তারা যে টাকা তুলেছেন, তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। বিষয়টি বর্তমানে দুদক অনুসন্ধান করছে। আপনি দেখতে চাইলে দেখাতে পারি।’

অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ১৩২ কোটি চার লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টাকা ছয়টি ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের প্রত্যক্ষ মদদ ও নির্দেশে তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে— এমন অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুদক। ভিন্ন ভিন্ন দল এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। বর্তমানে অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করছেন উপপরিচালক আকতার হামিদ ভূঁইয়া ও সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত দল।

অনুসন্ধান পর্যায়ে তিনটি ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ছয় প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ এবং ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাবেক ও বর্তমান কমিটির নেতৃবৃন্দ, নিরীক্ষা দলের সদস্যসহ ডজনখানেক ব্যক্তির বক্তব্য গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত কমিশনে কোনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি তারা।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্ব স্বল্পতম সময়ে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা নির্ধারিত ও কাঙ্ক্ষিত সময়ে তদন্ত শেষ করতে পারি না। আমাদের কাজ চলমান, আমরা কাউকে ছাড় দেব না।’

এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমবায় অফিসের নিরীক্ষা দল দুই বছরের হিসাব পর্যালোচনা করে ১৭৬ কোটি টাকার অসঙ্গতি পান। সেই প্রতিবেদনের বাইরেও এখন পর্যন্ত পাওয়া অন্যান্য নথিপত্রে প্রায় ৩৫৫ কোটি টাকা গরমিলের হিসাব মিলেছে। আমরা আরও যাচাই-বাছাই করছি। প্রমাণ পাওয়া গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।

আরএম/এমএআর/